চকরিয়া, কক্সবাজার: একটি বিস্তারিত লেখা
চকরিয়া, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলা, যা এর বিশাল আয়তন ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য পরিচিত। ৫০৩.৭৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলা কক্সবাজার জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা। এর অবস্থান ২১°৩৪´ থেকে ২১°৫৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৫৭´ থেকে ৯২°১৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৮ কিলোমিটার। উত্তরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও লোহাগড়া, এবং বান্দরবানের লামা উপজেলা, দক্ষিণে রামু ও কক্সবাজার সদর, পূর্বে বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি, এবং পশ্চিমে মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলায় চকরিয়া উপজেলা সীমান্তবর্তী।
নামকরণ: চকরিয়ার নামকরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি জনশ্রুতি প্রচলিত। একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, মাতামুহুরী নদীর চারটি বাকের কারণে এটি 'বাকচতুষ্টয়' বা 'চক্রবাক' নামে পরিচিত ছিল, যা পরবর্তীতে চকরিয়া হয়েছে। আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, এখানে প্রচুর চকুরী পাখির উপস্থিতির কারণে এই নামকরণ হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক ত্রিপুরা রাজাদের রাজমালা গ্রন্থে 'চাকরোয়া' নামের একটি গ্রামের উল্লেখ রয়েছে, যার সাথে চকরিয়ার নামকরণের সম্পর্ক বেশি প্রমাণিত। এক কালে কাকারা ইউনিয়নে চাক নামক একটি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করত, যাদের গ্রামের নাম ছিল 'চাকরোয়া'। এই চাকরোয়া থেকেই চকরিয়া নামকরণের ইতিহাস ভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রশাসন ও জনসংখ্যা: ১৭৯৩ সালে চকরিয়া থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এ উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। ২০১১ সালের জনসংখ্যা গণনার তথ্য অনুযায়ী, চকরিয়ার জনসংখ্যা ৪,৭৮,৪৬৫ জন, যার মধ্যে পুরুষ ২,৩৯,১৯৮ জন এবং মহিলা ২,৩৫,২৬৭ জন। মুসলিম ৯৩.৪%, হিন্দু ৫.৪%, বৌদ্ধ ১.০২% এবং খ্রিষ্টান ০.১৮%। এছাড়াও মগ, রাখাইন, মারমা, মুরং, চাকমা প্রভৃতি উপজাতি বসবাস করে। উপজেলার সাক্ষরতা হার ৬৭%।
অর্থনীতি ও শিক্ষা: চকরিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। চিংড়ি, লবণ, তামাক, বাদাম, সরিষা, ময়দা, তরমুজ, কাঠ, এবং উপকূলীয় মৎস্য উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, এবং প্রবাসী আয়ও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ১টি সরকারি কলেজ, ১টি ডিগ্রী কলেজ, ৫টি ফাজিল মাদ্রাসা, ৬টি উচ্চ মাধ্যমিক, ১টি আলিম মাদ্রাসা, ১টি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ৩৯টি মাধ্যমিক, ২৭টি দাখিল মাদ্রাসা, ১০টি নিম্ন মাধ্যমিক ও ২১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
যোগাযোগ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চকরিয়ার প্রধান যোগাযোগ সড়ক। এখানে ৪৫৫টি মসজিদ, ১৬০টি ঈদগাহ, ৫২টি মন্দির, ১৬টি বিহার এবং ৩টি গীর্জা রয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য রয়েছে ১টি সরকারি হাসপাতাল, ৭টি বেসরকারি হাসপাতাল (জমজম হাসপাতাল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য), ২টি দাতব্য চিকিৎসালয়, ৪৩টি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, এবং ১৫টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ: চকরিয়া প্রায়শই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১৬,৭০৫ জন মানুষ প্রাণ হারায়।
মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় চকরিয়ায় ১৩ জন গ্রামবাসী নিহত হন এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
চকরিয়া পৌরসভা: চকরিয়া পৌরসভা ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর গঠিত হয়। এটি একটি 'ক' শ্রেণীর পৌরসভা।
উল্লেখযোগ্য স্থান: চকরিয়ার মানিকপুরের মহিষের দই এর জন্য বিখ্যাত। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, এছাড়া অন্যান্য দর্শনীয় স্থান।
উপসংহার: চকরিয়া কক্সবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা যার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি একটি দ্রুত উন্নয়নশীল অঞ্চল। অধিক তথ্য পাওয়া গেলে আমরা এই লেখাটি আরও সমৃদ্ধ করব।