চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রকৃতির কোলে আবদ্ধ এই শহর পাহাড়, সমুদ্র এবং উপত্যকার মনোরম সমন্বয়ে ‘প্রাচ্যের রাণী’ নামে পরিচিত। এটি দেশের একমাত্র দ্বিমাত্রিক শহর এবং বঙ্গোপসাগরের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর। ২০২২ সালের হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৮২ লাখেরও বেশি।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
চট্টগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান মানচিত্রে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়। রেশমপথের অংশ হিসেবে এটি শতাব্দী ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ৯ম শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের বণিকরা এখানে ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। ১৪শ শতকে বাংলার মুসলমানরা চট্টগ্রাম জয় করে, এবং এটি দিল্লি সালতানাত, বাংলা সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ১৬শ শতকে পর্তুগিজরা এখানে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে, পরে ১৬৬৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য তাদের বিতাড়িত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সালে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ১৯২৮ সালে এটিকে ব্রিটিশ ভারতের প্রধান বন্দর ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার স্থান।
চট্টগ্রামের নামকরণ:
চট্টগ্রামের নামকরণের বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, প্রথম আরব বণিকরা ‘শাত ঘাংঘ’ (শাত = ব-দ্বীপ, ঘাং = গঙ্গা) শব্দ ব্যবহার করতেন। আরাকানী ইতিহাসে উল্লেখ আছে রাজা সু-লা-তাইং তসন্দায়া (সুলা তাইং চন্দ্র) একখন্ড পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন, যা ‘Tst-ta-gaung’ নামে পরিচিত ছিল। ‘চট্টগ্রাম’ নামটি সম্ভবত ‘চট্ট (সম্ভবত একটি বর্ণ বা উপজাতি) গ্রাম’ থেকে এসেছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্দর নগরী হিসেবে এটি দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে বহু বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থান এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল রয়েছে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বহু ব্যাংকের শাখা এখানে অবস্থিত।
ভৌগোলিক অবস্থান:
চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের পাদদেশে, কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। নগরীটি বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত এবং সমুদ্র সৈকত (যেমন পতেঙ্গা) ও পাহাড় (যেমন বাটালি পাহাড়) রয়েছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য:
চট্টগ্রামের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। আঞ্চলিক সংগীত, নৃত্য ও খাদ্য এ শহরের পরিচয় বহন করে। মেজবান, একটি ঐতিহ্যবাহী ভোজনোৎসব, এ শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহরের বৌদ্ধিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা:
চট্টগ্রামে সড়ক, রেল, বিমান এবং জলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশন ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে যুক্ত।
চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ:
চট্টগ্রামের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। নগর পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে আরও আধুনিক ও উন্নত শহরে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। নতুন এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার এবং কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে।