শেরপুর সদর উপজেলা: একটি বিস্তারিত লেখা
শেরপুর সদর উপজেলা বাংলাদেশের শেরপুর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত এবং ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। জেলার দক্ষিণে অবস্থিত এই উপজেলা উত্তরে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলা, দক্ষিণে জামালপুর জেলার জামালপুর সদর উপজেলা, পূর্বে নকলা উপজেলা এবং পশ্চিমে জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার সাথে সীমান্ত ভাগ করে নেয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন:
শেরপুর সদর উপজেলার আয়তন ৩৭২.৮৯ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৪,৯৭,১৭৯ জন, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৩৩৩ জন এবং বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৬%। উপজেলার অক্ষাংশ ২৪°৫৫´ থেকে ২৫°০৬´ উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৮৯°৫৩´ থেকে ৯০°০৭´ পূর্ব। এখানকার জলবায়ু উষ্ণ, আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ। শীতকালে প্রচুর কুয়াশা হয় এবং নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কখনো কখনো বৃষ্টিপাত হয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
শেরপুর একটি প্রাচীন জনপদ। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এ অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অধীনে ছিল, পরে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত কোচ সামন্তদের শাসনামলে ছিল। ১৪৯১ সালে সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের সেনাপতি মজলিস খাঁ কোচ রাজা দলিপা সামন্তকে পরাজিত করে গড়দলিপা দখল করে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় (১৬০৫-১৬১৭) সমগ্র ময়মনসিংহ মুঘলদের অধীনে আসে। পূর্বে শেরপুর 'দশকাহনিয়া' নামে পরিচিত ছিল। বাংলার নবাবী আমলে গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজীর নামানুসারে দশকাহনিয়ার নাম শেরপুর হয়।
প্রশাসন ও অবকাঠামো:
শেরপুর সদর উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। ১০০টি মৌজা ও ১৮৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এই উপজেলার সম্পূর্ণ প্রশাসনিক কার্যক্রম শেরপুর সদর থানার আওতাধীন। ১৮৬৯ সালে শেরপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেরপুরকে জেলায় উন্নীত করা হয় এবং ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪ সালে শেরপুর সদর উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেরপুরে প্রবেশ করে এবং ৭ ডিসেম্বর শেরপুর হানাদার মুক্ত হয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:
শেরপুর সদর উপজেলায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমি (১৮৮৭), গোবিন্দকুমার পিস মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট (১৯১৮), শেরপুর সরকারি কলেজ (১৯৬৪), শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ (১৯৭২) উল্লেখযোগ্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি সরকারি জেনারেল হাসপাতাল, একটি সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ১ টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, ১৩টি উপ-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৪১টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৮টি বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক এবং ১৯টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার।
অর্থনীতি:
শেরপুর সদর উপজেলা মূলত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। ধান, আলু, পাট, তামাক, বিভিন্ন শাক-সবজি ইত্যাদি ফসল উৎপন্ন হয়। শিল্প ও কলকারখানার মধ্যে আছে চালকল, ময়দাকল, তেলকল, বিড়ি কারখানা, পলিথিন কারখানা, ছাপাখানা। সড়কপথে সহজে যোগাযোগ করা যায়, বেসরকারি বাস পরিষেবাও রয়েছে, জলপথে নৌকা পরিবহনও আছে। উপজেলার মোট সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৬৬৮.৮ কিলোমিটার; এর মধ্যে পাকা রাস্তা ২৬৪.১১ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ৪০৪.৬৮ কিলোমিটার।
উপসংহার:
শেরপুর সদর উপজেলা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সমন্বয়ে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটির ভবিষ্যত উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।