বাংলাদেশে ‘হরিজন’ শব্দটি দ্বারা সাধারণত ব্রিটিশ আমলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়োনিষ্কাশন, চা-বাগান, রেলের কাজ ইত্যাদি কাজের জন্য আনা দরিদ্র ও দলিত জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। এরা প্রধানত অবাঙালি দলিত জনগোষ্ঠী হলেও, বাংলাদেশে স্থানীয় দলিত জনগোষ্ঠীও আছেন যাদেরকেও অনেক সময় হরিজন বলা হয়। এদের মধ্যে চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত। হরিজন শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও, মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৩ সালে ‘অস্পৃশ্য’ বলে বিবেচিত লোকদের এই নাম দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে এদেরকে কাজের জায়গা, কলোনিতে থাকতে দেওয়া হতো। তাদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া হতো, কিন্তু তাদের স্পর্শ করা নিষিদ্ধ ছিল। এরা সেলুন, রেস্তোরাঁ, রেলের কামরা, স্কুল-কলেজ পরিষ্কার করতো। স্বাধীনতার পরও, হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। তাদের অধিকাংশই পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের কাজের সময়, বেতন, নিরাপত্তা, আবাসন ইত্যাদি নিয়ে বহু সমস্যা বিদ্যমান।
মাগুরা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুষ্টিয়া, ঢাকা, যশোরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হরিজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এদের অনেকেই রাতের বেলায় কাজ করার সময় হত্যার শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের বেতন, চাকরির স্থায়ীকরণ, নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হয়। তাদের বসতি স্থান উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার বংশাল এলাকার মিরন জল্লা কলোনি উল্লেখযোগ্য। এই কলোনিতে বসবাসরত হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন পুনর্বাসনের দাবীতে আন্দোলন করেছে।
২০১৩ সালে মাযহারুল ইসলাম ও আলতাফ পারভেজের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসরত হরিজনদের সংখ্যা প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ। তাদের সঠিক সংখ্যা, জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা, আবাসন, ভূমি ও চাকরির অধিকার নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এজন্য একটি স্থায়ী দলিত হরিজন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।