মানবাধিকার: একটি বিস্তারিত আলোচনা
মানবাধিকার হলো মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। প্রত্যেক মানুষের জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার হিসেবে এটি তার জন্মের সাথে সাথেই তার অধিকার হয়ে যায়। এই অধিকার স্থান, কাল, সময় এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে এ অধিকার অন্যের অধিকার ও প্রশান্তিকে বিনষ্ট করে না। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইন মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানবাধিকারের ধারণাটি আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল হলেও, সমসাময়িক মানবাধিকারের ধারণার উদ্ভব ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। ১৯৪৮ সালের ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (ইউডিএইচআর) মানবাধিকারের ধারণাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত এই সনদ মানবাধিকারের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করে।
মানবাধিকারের ইতিহাসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রয়েছে: ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস দ্য গ্রেট’র ব্যাবিলনীয় দাসদের মুক্তি এবং সাইরাস সিলিন্ডারের ঘোষণা, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদীনা সনদ, ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস এবং ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস। এসব ঐতিহাসিক দলিল মানবাধিকারের ধারণা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসলাম ধর্মের কুরআনুল কারীম এবং মহানবী (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণেও মানবাধিকারের বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। সংজ্ঞা, সীমারেখা, এবং বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের পাশাপাশি ক্ষমতাধর শাসকদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনও চলছে। এছাড়াও, পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে মানবাধিকারের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার আন্দোলন: বাংলাদেশে মানবাধিকার আন্দোলনের সূচনা বিশ শতকের আশির দশকে। সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বেলা, বিএনডব্লিউএলএ, ব্লাস্ট প্রভৃতি সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকারের উন্নয়নে কাজ করছে। তবে সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারগুলির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও বহু দূরে। নারীর অধিকার, যৌনকর্মীদের অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার, বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রভৃতি ইস্যু বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: মানবাধিকারের ধারণাটি চিরন্তন ও সার্বজনীন। এটি বাস্তবায়নের জন্য সকলের সচেতনতা, প্রতিশ্রুতি এবং যৌথ প্রয়াসের প্রয়োজন।