সেলিম আল দীন: বাংলা নাট্যের এক অমূল্য সম্পদ
সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট, ১৯৪৯ - ১৪ জানুয়ারি, ২০০৮) ছিলেন একজন অসাধারণ বাংলাদেশী নাট্যকার ও গবেষক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তার অবদান অপরিসীম। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষার উপর গভীর গবেষণা করেছেন এবং বাংলা নাটকের ঐতিহ্যকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। ২০২৩ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সেলিম আল দীন। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি। শৈশব ও কৈশোর কাটে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে। ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখীলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও পরে টাঙ্গাইলের করোটিয়ার সাদত কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগীয় বাংলা নাট্যের উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকা থিয়েটারের সাথে যুক্ত হন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষে বিটপীতে কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকাল মৃত্যু হয়।
সেলিম আল দীন বাংলাদেশের একমাত্র নাট্যকোষের প্রণেতা এবং নিও এথনিক থিয়েটারের উদ্ভাবক। তিনি কাঁদো নদী কাঁদোসহ অনেক উপন্যাসকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সম্পাদনায় ‘থিয়েটার স্ট্যাডিজ’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ১৯৮১-৮২ সালে নাসির উদ্দীন ইউসুফের সাথে মিলে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।
তার রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ওমূল সমস্যা, প্রাচ্য, কীত্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতী কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি, চাকা, নিমজ্জন, হরগজ ইত্যাদি। তার নাটকে বাংলা জনপদের প্রান্তিক মানুষের চিত্র অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে।
পাশ্চাত্য শিল্পের বিভাজনকে অস্বীকার করে তিনি ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব’ প্রবর্তন করেন। তার নাটকে নিচুতলার মানুষের জীবন ও সংগ্রামের বহুস্তরিক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।
২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে তাকে সমাহিত করা হয়।