বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাস: একটি বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাস বহুমাত্রিক ও জটিল। এটি ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, ঐতিহাসিক ঘটনা, এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাবের সমন্বয়ে গঠিত। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে হিন্দু সমাজের বর্ণব্যবস্থা এবং মুসলমান সমাজের ‘শরাফতি’ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র বর্ণের বিভাজন ছিল, যদিও এ বিভাজন কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে আশরাফ, আজলাফ, এবং আরজল শ্রেণি বিভাজন ছিল, তবে এটি হিন্দু বর্ণব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি নমনীয় ছিল।
ঔপনিবেশিক যুগে কৃষি কাঠামো সামাজিক স্তরবিন্যাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগী, ধনী কৃষক, দরিদ্র কৃষক, এবং ভূমিহীন শ্রমিক - এই সকল শ্রেণির উত্থান ঘটে। নীল ও পাট চাষের ফলে একদিকে ধনী কৃষক শ্রেণির উত্থান ঘটলেও, অন্যদিকে ভূমিহীনদের সংখ্যাও বেড়ে যায়। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী শ্রেণির উত্থান ঘটে।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসে আরও পরিবর্তন আসে। জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ এবং হিন্দু জমিদারদের অনেকের ভারতে চলে যাওয়ার ফলে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে। কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ ধনী কৃষক শ্রেণির শক্তি বৃদ্ধি করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে অর্থনৈতিক শক্তির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ এলাকায় সম্পদের মালিকানা সামাজিক মর্যাদার প্রধান নির্ধারক হয়ে ওঠে, যদিও ঐতিহ্যবাহী বংশগতি ও গোষ্ঠী পরিচয় এখনও কিছুটা প্রভাব ফেলে। শহরাঞ্চলে শিক্ষা ও পেশা সামাজিক মর্যাদার গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং খুলনা শহর গুলি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে শহরাঞ্চলে মাস্তানদের আবির্ভাব সামাজিক স্তরবিন্যাসকে প্রভাবিত করেছে, যদিও তাদের সমাজে মর্যাদা কম। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শিক্ষার অভাব বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে, আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া চলমান এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে।