বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমির সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান। জলোচ্ছ্বাস, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ সমস্যা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এই প্রবন্ধে আমরা লবণাক্ত জমির বিভিন্ন দিক, এর প্রভাব, এবং সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
লবণাক্ততার প্রভাব:
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমি কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। লবণের অতিরিক্ত পরিমাণ ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, এবং কৃষকদের জীবিকা সংকটে ফেলে। শুধু কৃষিই নয়, লবণাক্ত পানি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
লবণাক্ততার কারণ:
লবণাক্ততার জন্য দায়ী কয়েকটি প্রধান কারণ হল:
- জলোচ্ছ্বাস: ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় লবণাক্ত সমুদ্রের পানি জমিতে প্লাবিত হয়, যা মাটিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। রিমাল ঘূর্ণিঝড়ের উদাহরণ এখানে উল্লেখযোগ্য, যেখানে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৩৭ হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছিল।
- নদীর পানির লবণাক্ততা: উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া ও কয়েক বছর ধরে কম বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের নদীগুলিতে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ বেড়ে যাচ্ছে।
- অবৈধ চিংড়ি চাষ: খুলনা, সাতক্ষীরা, ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় অবৈধ পাইপলাইনের মাধ্যমে নোনা পানি চিংড়ি ঘেরে ছেড়ে দেওয়ার ফলে কৃষিজমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লবণাক্ততার সমাধান:
লবণাক্ত জমির সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত: পোল্ডার বাঁধগুলিকে উন্নত ও উঁচু করা, এবং খালগুলো দখলমুক্ত করে খনন করা প্রয়োজন।
- স্বাদুপানি সংরক্ষণ: পুকুর সংরক্ষণ এবং স্বাদুপানির সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন: লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন।
- আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: কৃষিতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: লবণাক্ততার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
জরিপ ও পরিসংখ্যান:
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) ১৯৭৩ সাল থেকে দেশে মাটি ও পানির লবণাক্ততা জরিপ পরিচালনা করে আসছে। জরিপ অনুসারে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। বরিশাল বিভাগে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি অতিলবণাক্ত ছিল। বরগুনা জেলা লবণাক্ততার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল।
সংক্ষেপে:
বাংলাদেশের উপকূলীয় লবণাক্ত জমি একটি গুরুতর সমস্যা যা কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জলোচ্ছ্বাস, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং মানুষের কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড এর জন্য দায়ী। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন, যাতে বাঁধ নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনা, লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত থাকে।