কাবেরী: দক্ষিণ ভারতের প্রাণস্রোত ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু
দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কাবেরী নদী (Cauvery)। তৃতীয় বৃহত্তম নদী হিসেবে (গোদাবরী ও কৃষ্ণার পর) এই নদী কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং পুদুচেরির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর অববাহিকা ৮১,১৫৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।
উৎস ও প্রবাহপথ:
কাবেরীর উৎস কর্ণাটকের কোড়াগু জেলার পশ্চিমঘাটের ব্রহ্মগিরি পর্বতমালায় অবস্থিত তালকাবেরীতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৩৪১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই উৎসস্থল থেকে নদী কর্ণাটকের দ্বীপান্তরে প্রবাহিত হয়ে তামিলনাড়ুতে প্রবেশ করে। অমরাবতী, আরকাবতী, ভবানী, হেমাবতী, কাবিনী, লক্ষ্মণ তীর্থ, এবং নয়াল নদী কাবেরীর উল্লেখযোগ্য উপনদী। কর্ণাটকের শিবনসমুদ্রম জলপ্রপাত এবং তামিলনাড়ুর হোগেনাক্কাল জলপ্রপাত কাবেরীর উল্লেখযোগ্য জলপ্রপাতের উদাহরণ। শ্রীরঙ্গপট্টনাম ও শিবনসমুদ্র দ্বীপ এই নদীর উপর গঠিত।
ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব:
যুগ যুগ ধরে কাবেরী নদী দক্ষিণ ভারতের অনেক রাজ্যের প্রাণস্রোত হিসেবে কাজ করে এসেছে। হিন্দু ধর্মে এই নদী পবিত্র মনে করা হয় এবং এটি ভারতের সাতটি পবিত্র নদীর মধ্যে একটি। মহাভারত এবং পুরাণ সহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন তামিল সাহিত্যে এটিকে 'পোন্নি' (সোনালী) নামে ও ডাকা হতো। এর নামকরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাহিনীও প্রচলিত আছে।
জল বন্টন নিয়ে বিতর্ক:
কাবেরীর জল বন্টন নিয়ে কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিতর্ক চলে আসছে। ১৮৯২ সালের একটি চুক্তি এবং পরে ১৯৯০ সালে গঠিত কাবেরী ওয়াটার ডিস্পিউটস ট্রাইব্যুনালের (CWDT) রায় এই বিতর্কের অংশ। ২০০৭ সালে CWDT তাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করে। ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং পুদুচেরি এই নদীর পানির একটি নির্দিষ্ট অংশ পেয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
কাবেরী নদীর উপর অনেক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা সেচ এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। শতাব্দী ধরে এই নদী কৃষিকাজে অবদান রেখে এসেছে। গ্র্যান্ড অ্যানিকাট এবং মেট্টুর বাঁধ কাবেরীর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ১৯০২ সালে শিবনসমুদ্র জলপ্রপাতের উপর নির্মিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এশিয়ার প্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য:
কাবেরী অববাহিকা বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল। এখানে বাঘ, হাতি, গৌর, চিতা সহ অন্যান্য অনেক প্রাণীর বাস। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও জলজ প্রাণীর বাস।
উপসংহার:
কাবেরী নদী কেবল একটি নদী নয়; এটি দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এই নদীর জল বন্টন নিয়ে বিতর্ক এর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট করে। ভবিষ্যতে এই নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।