জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্য: পৃথিবীর জীবনের বৈচিত্র্যের অপরিসীম সম্পদ

পৃথিবীতে প্রাণের অপরিসীম বৈচিত্র্যকেই জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) বলে। এটি জীবনের জৈবিক বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনশীলতা, যা পৃথিবীর মাটি, জল ও বায়ুতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবদের মধ্যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে গঠিত। জীববৈচিত্র্যকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যেমন - ইউনাইটেড নেশন্স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) অনুসারে এটি কোনো অঞ্চলের অন্তর্গত সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্নতা। আবার, সি. জে. ব্যারো-র মতে এটি একটি বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্র্য, এমনকি একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্যও জীববৈচিত্র্যের অন্তর্গত।

  • *জীববৈচিত্র্যের বিভিন্ন স্তর:**

জীববৈচিত্র্য তিনটি প্রধান স্তরে বিবেচিত হয়:

1. **জিনগত বৈচিত্র্য (Genetic Diversity):** এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাপ্ত জিনের সব রকমের পার্থক্য। মিউটেশন (mutation) বা পরিব্যক্তি জিনের প্রবাহ ও জিনগত বৈচিত্র্য ঘটায়। উদাহরণ: Rauwolfia vomitoria উদ্ভিদের রোগ নিরাময়ের জন্য বন্য প্রজাতির রোগ প্রতিরোধী জিনগুলি প্রতিস্থাপন করে “ট্রান্সজেনিক ভ্যারাইটি”-এর উদ্ভিদ তৈরি করা হয়।

2. **প্রজাতিগত বৈচিত্র্য (Species Diversity):** কোনো বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের উপস্থিতি। নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসনের (১৯৯২) মতে বিশ্বে ১০ মিলিয়নের থেকে ৫০ মিলিয়ন জীবিত প্রজাতি আছে।

3. **বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য (Ecosystem Diversity):** একটি বিরাট অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রকারভেদ। বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে জিনগত বৈচিত্র্য এবং প্রজাতিগত বৈচিত্রের কারণেও বাস্তুতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য ঘটে।

  • *জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব:**

জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি খাদ্য, ঔষধ, শিল্পের কাঁচামাল, বিনোদন ও পর্যটন শিল্পের ভিত্তি প্রভৃতির জোগান দেয়। ম্যানগ্রোভ অরণ্য ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত ও সুনামির প্রভাব থেকে উপকূল অঞ্চলকে রক্ষা করে। দুর্যোগ নিবারণ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

  • *জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি:**

জীববৈচিত্র্য বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন- আবাসস্থলের ক্ষয়, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত শিকার, আক্রমণকারী প্রজাতি ইত্যাদি।

  • *জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ:**

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যেমন- জাতীয় উদ্যান স্থাপন, বন সংরক্ষণ, আইন প্রণয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক চুক্তিতে দেড় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশও এ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী।

  • *রেড ডাটা বুক:**

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (IUCN) বিপন্ন বা লুপ্তপ্রায় জীবপ্রজাতির একটি বিশদ তালিকা প্রকাশ করে, যা রেড ডাটা বুক নামে পরিচিত।

  • *বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য:**

বাংলাদেশের উর্বর পলিমাটি, উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু জীববৈচিত্র্যের জন্য অনুকূল। এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা এন্ড ফনা অব বাংলাদেশ’ কোষগ্রন্থে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের মোট প্রজাতির সংখ্যা ১২০০০ এর বেশি। ইলিশ (Temalosa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, দোয়েল (Copsychus saularis) জাতীয় পাখি এবং বাংলার বাঘ (Panthera tigris tigris) জাতীয় পশু।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণ করা সম্ভব।

মূল তথ্যাবলী:

  • জীববৈচিত্র্য হল পৃথিবীর জীবনের জৈবিক বৈচিত্র্য
  • জিনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য জীববৈচিত্র্য গঠন করে
  • জীববৈচিত্র্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
  • জীববৈচিত্র্য খাদ্য, ঔষধ, শিল্পের কাঁচামাল ইত্যাদির জোগান দেয়
  • জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও আবাসস্থলের ক্ষয় জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি