স্বচ্ছতা: একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা
সরকারের স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা সরকারের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম এবং তথ্যাবলি সম্পর্কে নাগরিকদের অধিগম্যতার সুযোগ নিশ্চিত করে। স্বচ্ছ আমলাতন্ত্রের মূল উপাদান হলো তথ্য বা উপাত্তের সহজপ্রাপ্যতা ও অধিগমন। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তথ্য আগলে রাখা এক ধরনের প্রতারণা। সরকারি কোনো সংস্থা যদি কোনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে কেন সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে তা নাগরিকদের অবহিত করা উচিত। বাস্তবতা থেকে নাগরিকদের দূরে সরিয়ে রাখা তাদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করার সামিল।
বাংলাদেশে সরকারের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রধান প্রক্রিয়া:
বিকেন্দ্রীকরণ: স্বচ্ছ আমলাতন্ত্র অধিগম্য ও বোধগম্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। এটা তখনই সম্ভব যখন প্রশাসনিক ব্যবস্থা মফস্বল এলাকা পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ দান করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ ধারণার ফলাফল হলো স্থানীয় সরকার। এর ফলে সরকারের ভেতর কি ঘটছে স্থানীয় লোকজন তা প্রত্যক্ষভাবে জানার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে সমগ্র সরকারি প্রশাসন ৪৪০৩টি ইউনিয়ন, ৪৬৩টি উপজেলা এবং ৬৪টি জেলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন: বাংলাদেশে ৬৪টি জেলায় কার্যরত জেলা প্রশাসন সরকারের বিকেন্দ্রীভূত রূপ। প্রতিটি জেলা প্রশাসন জাতীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং প্রতিটি জেলার নাগরিকদের সামাজিক সেবা প্রদানের মাধ্যম। প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসকের দপ্তর ও প্রশাসনিক আদালত রয়েছে। এর প্রধান হলেন জেলা প্রশাসক এবং ভূমিরাজস্ব আদায় ও জেলার জনসাধারণের বিচারব্যবস্থার জন্য তিনি দায়বদ্ধ। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং জনসাধারণের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিমাসে নিয়মিত তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়: আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সম্মেলন, বিচার বিষয়ক সম্মেলন এবং পুলিশ প্রশাসন বিষয়ক সম্মেলন।
স্বাধীন সংবাদপত্র: স্বচ্ছ সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রেস ও গণমাধ্যম অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপকর্ম, অনিয়ম ও অন্যায় প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের দায়িত্ব ব্যাপক। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজমান থাকলেই কেবল গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে এবং সুচারুরূপে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংবাদপত্র পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ভোগ করছে।
ন্যায়পাল: জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের উল্লেখ রয়েছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সরাসরি অভিযোগের মোকাবিলার ক্ষেত্রে ন্যায়পাল নিয়োগ একটি কার্যকর ব্যবস্থা।
সরকারি অর্থ সর্বজনীনভাবে বাজেট: সরকারি অর্থব্যয় নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল। বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব হলো বিভিন্ন ব্যয়খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা এবং সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয়ের বিধান অব্যাহত রাখা।
সংসদীয় প্রশ্নোত্তর: সরকারি নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশাসকদের প্রশ্ন করার সুযোগ সংসদ সদস্যদের আছে।
প্রশিক্ষণ: সরকারের দায়িত্ব হলো সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দান এবং প্রশাসনিক বিষয়ে রাজনীতিবিদদের পুনরবগত করানো। বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করে।
জনসাধারণের পরিবর্তনশীল প্রয়োজন এবং উদ্ভূত নতুন নতুন সমস্যার মোকাবিলায় সরকার কতটা তৎপর তা থেকেই সরকারি স্বচ্ছতা অনুধাবন করা যায়। স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল রাজনীতিতে বা আমলাতন্ত্রে স্বচ্ছতার অনুশীলন সম্ভব। [সৈয়দ নকীব মুসলিম]