সাইক্লোন

ঘূর্ণিঝড়: মহাসাগরের রুদ্রনাথ

বাংলাদেশের মতো উপকূলবর্তী দেশের জন্য ঘূর্ণিঝড় একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্রান্তীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তীব্র নিম্নচাপ, প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করে। ঘূর্ণিঝড়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সাইক্লোন’ গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ (Kyklos) থেকে এসেছে, যার অর্থ কুন্ডলী পাকানো সাপ। ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী হেনরী পিডিংটন ১৮৪৮ সালে প্রথম ‘সাইক্লোন’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি:

সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, নির্দিষ্ট গভীরতায়, এবং নিম্ন ও মধ্যস্তরে অধিক আর্দ্রতা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রধান কারণ। পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট করিওলিস বলের কারণে বাতাসের ঘূর্ণায়মান গতি তৈরি হয়। সাধারণত ১০ ডিগ্রী থেকে ৩০ ডিগ্রী অক্ষাংশের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগর এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ অঞ্চল।

ঘূর্ণিঝড়ের বৈশিষ্ট্য:

ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশকে ‘চোখ’ বলা হয়, যা প্রায় বৃত্তাকার এবং এর ব্যাস ৮-৫০ কিলোমিটার। চোখের বাইরের প্রান্তে বাতাসের গতিবেগ ও বৃষ্টিপাত সর্বাধিক। ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাস ৩০০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

শ্রেণীবিভাগ:

বাতাসের গতিবেগ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়কে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশে বাতাসের গতিবেগ অনুযায়ী নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শ্রেণীবিভাগ ব্যবহৃত হয়। ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের গতিবেগ সহ ঘূর্ণিঝড়কে সুপার সাইক্লোন বলা হয়।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস:

বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে ৩ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, যা ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়েও প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোক নিহত হয়। এছাড়াও ১৮৭৬ সালের বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়, ১৫৮২ সালের বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনা ইতিহাসে স্মরণীয়।

প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ:

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমাতে উন্নত সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, বনায়ণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি (সিপিপি) চালু করেছে এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করছে।

ঘূর্ণিঝড় একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

মূল তথ্যাবলী:

  • ঘূর্ণিঝড় ক্রান্তীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তীব্র নিম্নচাপ, প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস
  • ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি সমুদ্রের জলের উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার উপর নির্ভরশীল
  • বাতাসের গতিবেগ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়কে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়
  • ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক
  • ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমাতে উন্নত সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন