ভূমিকম্প: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক বিশ্লেষণ
ভূমিকম্প, পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরে শিলাস্তরে চাপের সঞ্চয়ের ফলে হঠাৎ শক্তি নির্গত হওয়ার ফলে সৃষ্ট ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন। এই কম্পন কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে, কখনও কখনও ৮-১০ মিনিট পর্যন্তও நீடி করতে পারে। কম্পনের তীব্রতা অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারিত হয়। মৃদু কম্পন অপরিচিত থাকতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘরবাড়ি ধ্বংস, প্রাণহানি ও ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলকে কেন্দ্র (ফোকাস) বলে এবং ঠিক উপরের ভূ-পৃষ্ঠের বিন্দুকে উপকেন্দ্র (এপিসেন্টার) বলা হয়। ভূগর্ভের ফাটল, স্তরচ্যুতি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধ্বস, খনিতে বিস্ফোরণ, এমনকি আণবিক পরীক্ষার ফলেও ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে।
- *ভূমিকম্পের প্রভাব:** ভূমিকম্পের প্রভাব ভয়াবহ। ভূ-ত্বকে ফাটল, চ্যুতি, সমুদ্রতলের উত্থান-অবনমন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পাহাড় থেকে বরফের পতন, সুনামি সৃষ্টি ইত্যাদি ঘটতে পারে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর হিন্দ মহাসাগরীয় ভূমিকম্প ও সুনামি ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বহু দেশে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ভূমিকম্পের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো, এবং জনজীবনেও ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে।
- *বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি:** বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চল ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের ভূ-চ্যুতিরেখা দ্বারা প্রভাবিত। বাংলাদেশে ৮টি সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা রয়েছে (যেমন: বগুড়া, রাজশাহীর তানোর, ত্রিপুরা, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ, হালুয়াঘাট-ডাউকি, ডুবরি, চট্টগ্রাম, সিলেটের শাহজীবাজার, রাঙামাটির বরকলে)। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার এবং ২০০৭ সালে ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। কোলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
- *ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকা:** বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা উচ্চ ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% মধ্যম ঝুঁকিতে (জোন-২) এবং ১৬% নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে কারণ ডাউকি চ্যুতি এখানে অবস্থিত। রাজশাহীও উচ্চ ঝুঁকির অঞ্চল। ঢাকার কাছে মধুপুর অঞ্চলে ৭-৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
- *প্রতিরোধ ব্যবস্থা:** ভূমিকম্প প্রতিরোধে প্রাক-দুর্যোগ পরিকল্পনা, ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবের ব্যবস্থা এবং জমি জরিপ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জনসাধারণকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করাও প্রয়োজনীয়।