বিস্কুট: এক অপরিসীম ইতিহাসের স্বাদ
বিস্কুট, ময়দাভিত্তিক এই খাদ্য উপাদানটির ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বহুমুখী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া লেগেছে বিস্কুটের রূপ ও রসায়। উত্তর আমেরিকার বাইরে বিস্কুট সাধারণত শক্ত, চ্যাপ্টা ও ঈস্ট ছাড়াই তৈরি হয়; উত্তর আমেরিকায় বিস্কুট নরম ও ঈস্টযুক্ত। ইংরেজি ভাষায় 'বিস্কুট' শব্দটির অর্থও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।
প্রাচীনকালের ইতিহাস:
দীর্ঘ যাত্রাপথে, বিশেষ করে সমুদ্রযাত্রায়, পুষ্টিসমৃদ্ধ, সহজে সংরক্ষণযোগ্য ও বহনযোগ্য খাবারের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রথমে পশুপালন করা হতো। কিন্তু এর ফলে যাত্রাপথ দীর্ঘ ও জটিল হতো। তাই শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হতো। পরবর্তীতে, শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আটা তৈরির মাধ্যমে খাদ্যের বিশ্বস্ত উৎস পাওয়া যায়। মিশরীয় নাবিকরা 'ধৌররা কেক' নামক এক ধরণের চ্যাপ্টা, ভঙ্গুর মিলেটের রুটি বহন করতো; রোমানরা 'বুকেলুম' নামক বিস্কুট ব্যবহার করতো।
ঔষধ ও বিস্কুট:
প্রাচীন চিকিৎসকরা মনে করতেন, অধিকাংশ রোগের কারণ হজমের সমস্যা। তাই, স্বাস্থ্যের জন্য দৈনিক বিস্কুট খাওয়া উপকারী বলে মনে করা হতো।
বিস্কুটের উন্নয়ন:
কঠিন বিস্কুট বয়সের সাথে নরম হয়ে যেতো। তাই, বেকাররা যথাসম্ভব কঠিন বিস্কুট তৈরি করার চেষ্টা করতো। কঠিন ও শুষ্ক হওয়ার কারণে, যথাযথ সংরক্ষণে এগুলো দীর্ঘদিন নষ্ট হতো না। দীর্ঘ যাত্রায়, বিস্কুট সাধারণত চারবার সেঁকা হতো। এই শক্ত বিস্কুট নরম করার জন্য, এগুলোকে ঝাল, কফি বা অন্যান্য তরলে ডুবিয়ে খাওয়া হতো।
বিভিন্ন ধরণের বিস্কুট:
আধুনিক বিস্কুট নোনতা (ক্র্যাকার) বা মিষ্টি হতে পারে। স্যান্ডউইচ-স্টাইল বিস্কুটে দুটি বিস্কুটের মাঝে 'ক্রিম' বা আইসিং থাকে। মিষ্টি বিস্কুট সাধারণত গমের আটা বা ওটস দিয়ে তৈরি হয়, এবং চিনি বা মধু দিয়ে মিষ্টি করা হয়। বিভিন্ন ধরণের বিস্কুটের মধ্যে রয়েছে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট, রিচ টি, হবনবস, চকোলেট ডাইজেস্টিভ, কাস্টার্ড ক্রিম ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বিস্কুট:
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে 'বেলা বিস্কুট' উল্লেখযোগ্য। এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিস্কুট, যা চা-সাথে খাওয়ার জন্য জনপ্রিয়। এর তৈরি পদ্ধতি ও উপকরণে রয়েছে অনন্যত্ব। 'ছিকর' নামক মাটির তৈরি বিস্কুট সিলেট অঞ্চলে জনপ্রিয়।
আধুনিক উৎপাদন ও রপ্তানি:
'প্রাণ পটাটা স্পাইসি বিস্কুট' বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য। এটি ৫৩ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর সাফল্যের পেছনে রয়েছে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও বাজার বিশ্লেষণ।
কোলে বিস্কুট:
একসময় পূর্ব ভারতের বিস্কুট শিল্পে 'কোলে বিস্কুট' একটি প্রভাবশালী নাম ছিল। 1948 সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটি তার গ্লুকোজ বিস্কুট ও অন্যান্য বেকারি পণ্যের জন্য জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সমস্যার কারণে এই কোম্পানিটি আর টিকে থাকতে পারেনি।
মারি বিস্কুট:
'মারি বিস্কুট' এক ধরণের সমৃদ্ধ চা বিস্কুট, যা বিভিন্ন নামে পরিচিত। ১৮৭৪ সালে লন্ডনের এক বেকারি প্রতিষ্ঠান এটি প্রথম তৈরি করেছিল। এটি ইউরোপ জুড়ে জনপ্রিয়, বিশেষ করে পর্তুগাল ও স্পেনে।
উপসংহার:
বিস্কুটের ইতিহাস অত্যন্ত বিস্তৃত ও আকর্ষণীয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উদ্ভাবন ও ব্যবসায়িক সাফল্য। এটি একই সাথে খাদ্য, ঐতিহ্য, ও অর্থনীতির জটিল সম্পর্কের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।