পোশাক: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিবর্তন
বস্ত্র, বা পোশাক, মানুষের সভ্যতার অঙ্গ। শরীরের আচ্ছাদন ছাড়াও, এটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও আবহাওয়ার প্রভাবের প্রতিফলন বহন করে। পোশাকের ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ, বিজ্ঞানীদের মতে, ৪০,০০০ থেকে ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষ পোশাক পরা শুরু করেছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে কোন একক তথ্যই সর্বজনীনভাবে গৃহীত নয়।
প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাবলী যেমন ঋগ্বেদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, এবং উপনিষদে পোশাকের উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণ ও মহাভারতেও বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের পোশাকের বর্ণনা রয়েছে। গাঙ্গেয় সমভূমির খননকার্যে সুতা কাটা, বস্ত্রবয়ন ও রং করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাঁচি, ভরত, অমরাবতী ও উড়িষ্যার প্রস্তর ও মৃত্তিকা নির্মিত ভাস্কর্য, এবং বাংলাদেশের দিনাজপুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলক সেসময়কার পোশাকের ধরন সম্পর্কে ধারণা দেয়। চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন-সাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্তেও পোশাকের বিবরণ রয়েছে। কালিদাসের রচনায় শিকার, সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুকদের পোশাকের উল্লেখ রয়েছে এবং 'চীনাংশুক' নামক রেশমি বস্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
পনেরো শতকে মুসলিম প্রভাব উপমহাদেশের পোশাকে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনে। আটো পাতলুন, লম্বা কোট, পাগড়ি ইত্যাদি পোশাকের চল ছিল। মুগল সম্রাট আকবরের আমলে মেয়েদের পোশাকে রাজপুত প্রভাব লক্ষণীয় ছিল; নেকাব, ঘাগরা, কাঁচুলি ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জামদানি, কশিদাজরি ও চিক্কন সূচিকর্মের প্রসার ঘটে। পুরুষদের পোশাকে আচকান বা শেরওয়ানি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পোশাকে পাশ্চাত্য প্রভাব বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরুষেরা শার্ট, প্যান্ট, স্যুট ও টাই পরা শুরু করে। মহিলারা শাড়ি পরা অব্যাহত রাখলেও ব্লাউজের নকশা ও কাপড়ের বৈচিত্র্য দেখা যায়। 1980 এর দশক থেকে টেলিভিশন ও বিদেশ ভ্রমণের ফলে পোশাকের ফ্যাশনে নতুন প্রবণতা দেখা দেয়।
আধুনিক যুগে পুরুষদের পোশাকে পাঞ্জাবি, থ্রিপিস স্যুট জনপ্রিয়, অফিসে প্যান্ট-শার্টের ব্যবহার ব্যাপক। মহিলাদের পোশাকে শাড়ি প্রধান হলেও, সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস ব্যবহার বেড়েছে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নকশা ও রঙের বৈচিত্র্য অতুলনীয়। তাদের পোশাক তৈরির কাঁচামাল বর্তমানে জুম ক্ষেতের তুলা ও মিলের সুতা দুইই।
আজকের বাংলাদেশে পোশাক, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ।