চট্টগ্রামের চন্দনাইশ: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়
চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত চন্দনাইশ উপজেলা, একই সাথে একটি প্রাচীন জনপদ ও আধুনিক উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়। ঐতিহাসিক ঘটনা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক দিয়ে এ উপজেলা সমৃদ্ধ।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
২০১.৯৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলার অবস্থান ২২°০২´ থেকে ২২°০৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৪৯´ থেকে ৯২°০৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উত্তরে পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়া, দক্ষিণে সাতকানিয়া, পূর্বে বান্দরবান সদর ও সাতকানিয়া এবং পশ্চিমে আনোয়ারা উপজেলা অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী উপজেলার জনসংখ্যা ২,৩৩,০১৭ জন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
চন্দনাইশের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। ১৬৬৬ সালে মুগল বাহিনী উত্তর চট্টগ্রাম দখল করার পর, মোর্তজা খাঁ'র নেতৃত্বে মুগল বাহিনী কর্ণফুলি নদী পার হয়ে শঙ্খ নদীর উত্তর তীরে দোহাজারীতে অবস্থান নেয়। এখানে দুটি দুর্গ নির্মিত হয়। ব্রিটিশরা দোহাজারীতে একটি বিমান ঘাটি নির্মাণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দোহাজারীতে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়, যাতে পাকবাহিনীর পরাজয় ঘটে। চট্টগ্রাম শহর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দোহাজারীতে স্থানান্তরিত হয়। চন্দনাইশের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট খান মসজিদ, নবরত্ন বিহার, বুড়ি কালি মন্দির ও খান দিঘি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড:
কৃষি, ব্যবসা, পরিবহন ও যোগাযোগ, চাকরি, নির্মাণ, এইসব ক্ষেত্র চন্দনাইশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধান, গম, আখ, আলু, মরিচ, সরিষা, শাকসবজি প্রধান কৃষি ফসল। কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লেবু প্রধান ফল। রেলওয়ে স্লিপার, কাঠের আসবাবপত্র, দুধ, মুরগি, পেয়ারা, লেবু, আনারস, শাকসবজি প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। গার্মেন্টস, হিমাগার, বরফকল, প্রিন্টিং প্রেস ইত্যাদি শিল্প কারখানাও চালু রয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা:
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চন্দনাইশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। ৮১ কিমি পাকা রাস্তা, ১৪১ কিমি আধা-পাকা রাস্তা ও ২০২ কিমি কাঁচা রাস্তার পাশাপাশি রেলপথও রয়েছে। দোহাজারী, হাশিমপুর, গাছবাড়িয়া খান হাট তিনটি রেলস্টেশন চন্দনাইশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য:
২৭৫টি মসজিদ, ৭০টি মন্দির, ১১টি কিয়াং, ২০টি মাযার, ১টি তীর্থস্থান, ৯টি লাইব্রেরি, ২০টি ক্লাব, ২টি প্রেসক্লাব, ২টি সিনেমা হল, ১টি মহিলা সংগঠন এবং ১টি স্টেডিয়াম চন্দনাইশের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:
৫৩.৬% সাক্ষরতার হার নিয়ে চন্দনাইশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নততর অবস্থায় রয়েছে। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গাছবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ, সাতবাড়িয়া কলেজ, আমানতছফা বদরুন্নেছা মহিলা কলেজ, জামিজুরী কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ অন্যতম। একটি হাসপাতাল, ২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১০টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র এবং ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক উপজেলার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে।
উপসংহার:
ঐতিহাসিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপূর্ব সমন্বয় নিয়ে চন্দনাইশ উপজেলা চট্টগ্রামের এক গৌরবময় অংশ। এই উপজেলার উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের রক্ষণাবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।