হালিম: ঐতিহ্যের স্বাদের এক অপূর্ব সমাহার
হালিম, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায় জনপ্রিয় এক সুস্বাদু খাবার। বিভিন্ন ধরণের ডাল, গম, মাংস এবং গরম মশলার অপূর্ব মিশ্রণে তৈরি এই খাবারটি রমজান মাসে ইফতারের আদর্শ খাবার হিসেবে বিশেষ পরিচিত। হালিমের স্বাদ ও গন্ধের বিভিন্নতা নির্ভর করে ব্যবহৃত মশলা এবং ডালের অনুপাতের উপর। গরু, মুরগি অথবা খাসির মাংস ব্যবহার করে হালিম তৈরি করা হয় এবং মাংসের ধরণ অনুযায়ী এর নামকরণও হয়, যেমন- গরুর গোশতের হালিম, মোরগ হালিম, মাটন হালিম। তবে বিভিন্ন দোকানে তৈরি হালিমের নামকরণ দোকানদারদের নাম অথবা অন্যান্য বিষয়ের সাথে জড়িত থাকে যেমন মামা হালিম, চাচা হালিম, রাহমানিয়া হালিম ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
হালিমের উৎপত্তি হারিশ নামক জনপ্রিয় আরব খাবার থেকে। খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে বাগদাদে 'কিতাব-আল-তাবিখ' নামক রান্নার বইয়ে হারিশের প্রাচীনতম লিখিত রেসিপি পাওয়া যায়। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার। ইবন বতুতার ভ্রমণকাহিনীতেও পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিশের উল্লেখ রয়েছে। রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে, উপমহাদেশের হালিম মধ্যপ্রাচ্যের হারিশা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। লেবানী রন্ধনশৈলীর উপর আনিসা হেলউয়ের গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, লেভান্তে গরিবদের খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিশা রান্না করা হতো। স্পেনের ইহুদিরা সাবাথে হারিশ রান্না করত। ভারতে হারিশার আগমন ঘটে মুঘলদের মাধ্যমে, হুমায়ূনের আমলে এসে জনপ্রিয়তা পায় আকবরের রাজত্বকালে। আইন-এ-আকবরীতে হারিশার উল্লেখ আছে। হায়দ্রাবাদের নিজামদের আরব সৈন্যরা হারিশা হায়দ্রাবাদে এনেছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। বিংশ শতকে হালিমের জনপ্রিয়করণে সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। নিজামদের যুগের অবসানের পর ১৯৫০-এর দশকে হায়দ্রাবাদের ইরানি হোটেলগুলোতে প্রথম হালিম বিক্রি শুরু হয়।
প্রস্তুতি প্রণালী:
হালিমের মূল উপাদান বিভিন্ন রকমের ডাল, গম, বার্লি, সুগন্ধি চাল এবং গোশত। ডাল কয়েক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর সেদ্ধ করা হয়, চাল ও গমও সিদ্ধ করা হয়। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, এলাচ, মরিচ, হলুদ, দারুচিনি ও গরম মশলা দিয়ে আলাদা পাত্রে গোশত কষিয়ে নেওয়া হয়। এরপর সিদ্ধ ডাল, চাল ও গম কষানো মাংসের সাথে মিশিয়ে, পানি ও লবণ যোগ করে ঘণ্টাখানেক রান্না করা হয়। পরিবেশনের সময় পেঁয়াজের বেরেস্তা, সবুজ ধনেপাতা, আদা, কাঁচা মরিচ ও লেবু যোগ করা হয়। স্থানভেদে ও রাঁধুনিভেদে হালিমের প্রস্তুতি প্রণালীতে ভিন্নতা থাকতে পারে।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা:
হালিম বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশেষ করে রমজান মাসে ইফতারে এটি প্রধান খাবার হিসেবে থাকে। পাকিস্তানে সারা বছর ধরে রেস্তোঁরা এবং বাজারে হালিম পাওয়া যায়। ভারতে হায়দ্রাবাদে রান্না করা হালিম বিশেষ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পাঠানো হয়। হায়দ্রাবাদী হালিম ভারতের প্রথম মাংসজাত পণ্য হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) সার্টিফিকেট পেয়েছে।