বাংলাদেশে সিসা দূষণ: একটি জাতীয় সংকট
বাংলাদেশে সিসা (লেড) দূষণ একটি ব্যাপক ও উদ্বেগজনক পরিবেশগত স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে বাতাস, পানি, মাটি, খাদ্য, রঙ এবং রান্নার পাত্র ইত্যাদির মাধ্যমে সিসার সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি রয়েছে বলে ইউনিসেফের তথ্যে উঠে এসেছে।
সিসার উৎস:
সিসা দূষণের প্রধান উৎস হলো পুরোনো সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির পুনঃচক্রায়ন, সিসা মিশ্রিত রঙ, সিসাযুক্ত হলুদ, ই-বর্জ্য, ধাতুর তৈজসপত্র (সীসার প্রলেপ), মসলা, গয়না তৈরি, সোনার বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ, ধর্মীয় গুড়া এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধ। জাহাজ ভাঙা শিল্পও সিসা ও অ্যাসবেস্টস ছড়িয়ে পড়ার একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। ভারত থেকে আমদানি করা কোহিনুর বাসমতি চালেও সিসা পাওয়া গেছে।
সিসার প্রভাব:
শিশুদের রক্তে সিসার উপস্থিতি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে, স্মৃতিশক্তিতে, আচার-আচরণে, শারীরিক বৃদ্ধিতে এবং স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং গর্ভবতী নারীদের অনাগত শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যে কোন পরিমাণ সিসাই ক্ষতিকর, এবং এর কোন নিরাপদ মাত্রা নেই।
সরকারি উদ্যোগ:
সরকার সিসা দূষণ মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া কারো সীসা প্রক্রিয়াজাতকরণের অনুমোদন নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে সিসা দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং এর ক্ষতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগে বিপজ্জনক পদার্থ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বিধি তৈরি করা হবে, এবং দূষণের উৎস শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডি, এডিবি, পিউর আর্থ বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন জাতীয় সংগঠন এই উদ্যোগে সহযোগিতা করছে।
গবেষণা ও পরিসংখ্যান:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS), ইউনিসেফ এবং ইউএসএআইডি ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)’ এর মাধ্যমে রক্তে সিসার উপস্থিতি ও দূষণের উৎস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে। আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর, বি ও এই ক্ষেত্রে গবেষণা কাজে নিয়োজিত। এই গবেষণা ও পরিসংখ্যান ভবিষ্যতে সিসা দূষণ মোকাবিলায় কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য:
সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সিসা দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। শিশুদের সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা এবং তাদের সুস্থ ও নিরাপদ বিকাশ নিশ্চিত করা এই উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য।