সামরিক বাহিনী: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্লেষণ
একটি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী হলো ঐ রাষ্ট্রের সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিরক্ষা ও আক্রমণকারী বাহিনী এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত সংস্থা সমূহ। রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রনীতির উপর তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে। কিছু কিছু দেশের সামরিক বাহিনীতে আধাসামরিক বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত হয়।
সামরিক বাহিনীর ব্যবহার শিক্ষাকে সামরিক বিজ্ঞান বলে। ব্যাপক অর্থে, সামরিক বিজ্ঞান আক্রমণ ও প্রতিরক্ষাকে তিনটি “স্তরে” বিবেচনা করে: স্ট্র্যাটিজি, অপারেশনাল ওয়ারফেয়ার এবং কৌশল (tactics)। তিনটি স্তরেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শক্তি প্রয়োগ ব্যবস্থা আলোচিত হয়।
সামরিক শব্দের দুটি ব্যাপক অর্থ আছে। প্রথম অর্থে, সৈন্য ও সৈন্য সমাবেশ বোঝায়। দ্বিতীয় অর্থে, সামরিক বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে বোঝায়। বহু বছরে মিলিটারি ইউনিটগুলো বিভিন্ন আকার ও আকৃতি লাভ করেছে। মিলিটারি ইউনিটগুলো, সামন্তরাজের নেতৃত্বে লড়াইয়ের জন্য গুটিকয় সাধারণ কৃষকের সমন্বয়ে গঠিত মধ্যযুগীয় দলের মত ক্ষুদ্র আয়তন হতে, ১৯৪৪ সালের ডি-ডে’র জন্য গঠিত অধিক্রম বাহিনীর মত বৃহৎ আয়তন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলো সাকা জুলুর ইম্পির মত কঠোরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে পারে, আবার নাইটস টেম্পলারের মত প্রায় স্বতন্ত্রও হতে পারে। কিছু রাষ্ট্র - যেমন স্পার্টা বা আধুনিক কালের প্রুশিয়া - সামরিক বিক্রমকে সরকারের কেন্দ্রে স্থান দেয়।
সৈন্য সমাবেশের কার্যক্রম ইতিহাসের সুরু থেকে হয়ে আসছে। বর্তমান কালে, যুদ্ধ ও অন্যান্য দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক ভূ-অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অনেক সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ও পতন সাধন; নতুন রাষ্ট্রের গঠন ও বিলুপ্তি সাধন হয়েছে। ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং সামরিক শক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখনও আধিপত্য করছে। বর্তমান সমাজে সামরিক ভূমিকা পূর্বাপেক্ষা অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকে সংঘর্ষের মাধ্যমে ইতিহাসের গতি বয়ে চলেছে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধাস্ত্রের বিবর্তন, সামরিক বাহিনীর প্রকৃতি ও সমরকুশলতা, যুদ্ধের প্রকৃতি ও প্রভাবকে তুলে ধরা হল সামরিক ইতিহাস। সামরিক বাহিনী প্রাচীনকাল হতে বিদ্যমান প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ সংক্রান্ত সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সামরিক বাহিনীর গঠন, যথা- অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের ধরন, যানবাহন, রসদ সরবরাহ, চাকরিতে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সব সময়ই পরিবর্তনশীল থেকেছে। সামরিক বাহিনীর আকার ও গঠন নির্ভর করত রাষ্ট্রের আকারের ওপর।
- *বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:**
- **প্রাচীন যুগ:** পাল, চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজবংশের সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সেনাপতি’ অথবা ‘মহাসেনাপতি’ ছিলেন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা।
- **মধ্যযুগ (সুলতানি ও মুগল আমল):** সুসংগঠিত সেনাবাহিনী ছিল; পদাতিক, অশ্বারোহী, গোলন্দাজ, হস্তি ও নৌবাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাইকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
- **ঔপনিবেশিক যুগ:** ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি পাহারা দেয়ার জন্য সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্য সংগ্রহের মাধ্যমে শুরু, ধীরে ধীরে নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন। রবার্ট ক্লাইভ 'লাল পল্টন' গঠন করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ও পরবর্তী পুনর্গঠন।
- **পাকিস্তান আমল:** ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে গঠন। ১৯৪৮ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৃষ্টি।
- **বাংলাদেশ আমল:** ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উত্থান। মুক্তিবাহিনীর গঠন এবং এগারোটি সেক্টরে বিভক্তি। ১৯৭১ পরবর্তী সম্প্রসারণ এবং সাংগঠনিক কাঠামো। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ।
- **সামরিক শাসন:** ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন। বাংলাদেশে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রায়নের প্রচেষ্টা।
- *বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহ:**
- স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাক্টিকস (SI&T)
- বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (BMA)
- আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইনস্টিটিউট (AFMI)
- ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (DSCSC)
- ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (NDC)
- মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (MIST)
- আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ (AFMC)
- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (BIPSOT)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস দীর্ঘ ও জটিল। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিক যুগে এর ভূমিকা আরও ব্যাপক এবং জটিল হয়ে উঠেছে।