লামা উপজেলা: পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি রত্ন
বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার অন্তর্গত লামা উপজেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বান্দরবানের অন্যতম জনবহুল উপজেলা হিসেবে লামা এর ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৬৭১.৮৪ বর্গ কিলোমিটার (১,৬৬,০১৫ একর) আয়তনের এই উপজেলাটি ২১°৩৬´ থেকে ২১°৫৯´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৪´ থেকে ৯২°২৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে লামার দূরত্ব প্রায় ৯২ কিলোমিটার।
- *ঐতিহাসিক পটভূমি:** লামা নামকরণের কয়েকটি মত রয়েছে। কিংবদন্তী অনুসারে, 'আহলামা' নামক এক মার্মা নারীর নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজা ধন মানিক্য চট্টগ্রাম দখল করে লামার আধিপত্য বিস্তার করেন। ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে বোমাং রাজার পূর্বপুরুষ আরাকান রাজার অধীনে চট্টগ্রামের গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের হাতে চট্টগ্রাম দখল হলে, বোমাং আরাকানে ফিরে যান। বার্মিজদের অত্যাচারের কারণে মার্মা ও রাখাইনরা আরাকান ত্যাগ করে পালোংক্ষি (বর্তমান কক্সবাজার) ও লামাসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চল দখল করে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করে, যেখানে লামা বোমাং সার্কেলের অন্তর্গত ছিল। ১৯২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর লামা থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮৫ সালে তা উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।
- *মুক্তিযুদ্ধ:** মুক্তিযুদ্ধকালে লামা ১নং সেক্টরের অধীনে ছিল। পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর তেমন সক্রিয়তা ছিল না, তবে রাজাকার ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তান সমর্থক ফুরুইক্ষা বাহিনী অত্যাচার চালিয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ লামা থানা আক্রমণে বিরাট সাফল্য অর্জন করেন।
- *জনসংখ্যা ও ধর্ম:** ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লামার জনসংখ্যা ১,৩৯,৬৮১ জন। মোট জনসংখ্যার ৭১.০৯% মুসলিম, ২.৯২% হিন্দু, ১৭.০৯% বৌদ্ধ এবং ৬.২৪% খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মার্মা, ত্রিপুরা, মুরং, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও খেয়াং সহ বিভিন্ন উপজাতি লামায় বসবাস করে।
- *অর্থনীতি:** লামার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। রাবার, তামাক, ধান, আদা, হলুদ, বিভিন্ন মৌসুমি ফলের চাষ এখানে প্রধান। প্রায় ১৫০০টি রাবার বাগান ও সাড়ে ৭০০টি ফল বাগান জাতীয় রাজস্বে ব্যাপক অবদান রাখে। ফাঁসিয়াখালীর ইয়াংছা এলাকায় গ্যাস ও রূপসীপাড়ায় কয়লার খনি আছে। বিপুল পরিমাণ খনিজ পাথর ও বালু সম্পদ সিমেন্ট কারখানা ও সিরামিক শিল্পের সম্ভাবনা বহন করে। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (BATB) এবং জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (JTI) লামায় তামাক ব্যবসার সাথে জড়িত।
- *যোগাযোগ:** মাতামুহুরী নদী ছাড়াও লামা খাল ও ইয়াংছা খাল যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবদান রাখে। বান্দরবান-লামা এবং চকরিয়া-লামা সড়ক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। পূর্বাণী চেয়ারকোচ ও জীপগাড়ি প্রধান পরিবহন।
- *শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:** লামায় ১টি ডিগ্রী কলেজ, ১টি ফাজিল মাদ্রাসা, ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি দাখিল মাদ্রাসা, ৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৭৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে।
- *দর্শনীয় স্থান:** লামা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মাতামুহুরী নদী, অসংখ্য ঝিরি, পাহাড় ও বনভোজনের উপযোগী অনেক স্থান লামাকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
- *লামা জেলা ঘোষণার দাবি:** লামার উন্নয়নের জন্য এবং আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির সাথে ভৌগোলিক সুবিধার জন্য লামা উপজেলাকে জেলা ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিন ধরে উত্থাপিত হয়ে আসছে। লামা উন্নয়ন ও জেলা বাস্তবায়ন কমিটি, লামা নাগরিক ফোরাম সহ বিভিন্ন সংগঠন এই দাবিতে সক্রিয়।