বাউল সম্প্রদায় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী একদল মরমি সাধক ও সঙ্গীতশিল্পী, যারা সুফিবাদ ও বৈষ্ণবধর্মের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এক অনন্য দর্শনের অনুসারী। তাদের সাধনার প্রধান মাধ্যম হলো সঙ্গীত, যাকে বাউল সংগীত বলা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাউল শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের (১৭৭৪-১৮৯০) গানের মাধ্যমে এই মতাদর্শ সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল সংগীতকে বিশ্বের মৌখিক ও অমূর্ত ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করে।
বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর আছে। কিছু গবেষক এর উৎপত্তি সংস্কৃত ‘বাতুল’ (পাগল) অথবা ‘বায়ু’ (প্রাণশক্তি) থেকে ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে, কেউ কেউ আরবি ‘বাউর’ (স্বেচ্ছাচারী) অথবা পারস্য ‘আউল’ থেকে এর উৎপত্তি মনে করেন।
বাউলদের দুটি প্রধান শ্রেণী আছে: গৃহত্যাগী বাউল এবং গৃহী বা সংসারী বাউল। গৃহত্যাগী বাউলরা সংসার ও সমাজ ত্যাগ করে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন, সাদা পোশাক পরিধান করেন এবং সন্তান ধারণ করেন না। গৃহী বাউলরা স্ত্রী-পুত্রসহ নির্দিষ্ট পাড়ায় বাস করেন, কিন্তু সমাজের অন্যদের সাথে তেমন মিশেন না।
বাউলদের প্রসার কুষ্টিয়া-পাবনা এলাকা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বোলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে বীরভূমের জয়দেব-কেন্দুলিতে 'জয়দেব বাউলমেলা' অনুষ্ঠিত হয়। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার অধিকারী, আত্মাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন এবং মানবতার বাণী প্রচার করেন।
বাউল সাধকদের মধ্যে ফকির লালন সাঁই সবচেয়ে বিখ্যাত। তার অসংখ্য গানে বাউল মতাদর্শ ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার লক্ষ্য করা যায়। তারা একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, ঢোলক, খমক প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন।
পুরুষদের পাশাপাশি, বহু মহিলা বাউল সাধনায় ও গান পরিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে, কৃষিজীবী, তন্তুবায় ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাউল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাউল সংগীতের আধুনিক সংস্করণে 'বাউল রক' এর জনপ্রিয়তাও বেড়ে চলেছে।