কূটনীতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ
কূটনীতি (Diplomacy) হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যেখানে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি বা আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক পরিচালনার কলাকৌশল অধ্যয়ন করা হয়। এটি কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রমও বোঝায়। বাংলায় ‘কূটনীতি’ শব্দটি ‘কূট’ ও ‘নীতি’ শব্দদ্বয়ের যোগে গঠিত। ‘কূট’ শব্দের অর্থ কৌশলপূর্ণ, জটিল, আর ‘নীতি’ শব্দের অর্থ রীতি, নিয়ম। তাই কূটনীতির অর্থ হলো কৌশলপূর্ণ নিয়ম, যা প্রধানত রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড বোঝায়।
ইংরেজি ‘Diplomacy’ শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ডিপ্লোমা’ থেকে উদ্ভূত। ‘ডিপ্লোমা’ মানে ভাঁজ করা, যা গুরুত্বপূর্ণ দলিল রক্ষার প্রথা বোঝায়। ফ্রান্সে ১৭ শতক থেকে বিদেশে অবস্থানকারী বাণিজ্যিক ও সরকারি প্রতিনিধি দলকে কূটনৈতিক দল বলা হতো। ১৭৯৬ সালে এডমন্ড বার্ক প্রচলিত ফরাসি শব্দ ‘diplomatie’ থেকে ‘কূটনীতি’ শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত হয়। কৌটিল্যের রাজনীতিশাস্ত্র ‘কূটনীতি’র প্রাচীনতম উৎস।
কূটনীতির ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতা থেকেই শুরু। মিশরের ফারাও এবং কানানের অমুরু শাসকদের মধ্যে ১৪ শতক খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘আমর্না লেটার’ এর মাধ্যমে চিঠিপত্র আদান-প্রদান, মেসোপটেমিয়ার ল্যাগাশ ও উম্মার মধ্যে ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শান্তি চুক্তি, ১২৭৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর ও হিট্টাইটদের শান্তি চুক্তি - এগুলো কূটনীতির প্রাথমিক উদাহরণ। প্রাচীন গ্রীসের নগর-রাষ্ট্রগুলিও কখনো কখনো দূত প্রেরণ করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করত। চীনের হান রাজবংশ, সাং রাজবংশ, মঙ্গোল সাম্রাজ্যের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডও উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন ভারতে কৌটিল্য (চাণক্য) রচিত অর্থশাস্ত্রে কূটনীতির বিশদ বিশ্লেষণ রয়েছে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ‘বর্বরদের ব্যুরো’ প্রথম গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করত।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে উত্তর ইতালির রাষ্ট্রগুলি কূটনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৩ শতক থেকে দূতাবাস স্থাপন শুরু হয়। মিলান, টাস্কানি, ভেনিস ছিল কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ১৫ ও ১৬ শতকে আধুনিক কূটনীতির নীতি-নিয়ম উন্নত হয়। ফ্রান্সের রাজনীতিতে কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, এবং নেপোলিয়নের সময়কালে কূটনীতি নতুন মাত্রা পায়। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেস আধুনিক কূটনীতিতে নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীতে কূটনীতি পেশাদারিত্ব লাভ করে। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন কূটনৈতিক কার্যক্রমের নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে। কূটনীতির সাথে গোয়েন্দা সংগ্রহ ও স্পাই অপারেশন জড়িত। শান্তি রক্ষায় আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কূটনীতির বিভিন্ন কৌশল- শান্তিপূর্ণ আলোচনা, সহযোগিতা, অর্থনৈতিক কূটনীতি, জনমত গঠন, প্রচার ইত্যাদি। ছোট রাষ্ট্রগুলির কূটনীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে ডিজিটাল কূটনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে।