আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: একটি বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations, সংক্ষেপে IR) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যা রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এবং বিশ্ব ইস্যুসমূহের বিশ্লেষণ করে। এর আওতায় রাষ্ট্রের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারী সংস্থা এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়। এটি একাধারে শিক্ষাগত ও সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্র, ইতিবাচক ও আদর্শিক দুই দিকই ধারণ করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞায় অধ্যাপক পামার ও পারকিন্স বলেছেন, "বিশ্বসম্প্রদায়ের মত আন্তর্জাতিক সর্ম্পকের অধ্যয়নও পরিবর্তনশীল।" রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়াও অর্থনীতি, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক আইন, দর্শন, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক গবেষণা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বিশ্বায়ন, বাস্তু সহনশীলতা, নিউক্লীয় শক্তি, জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ, অপরাধ, মানব নিরাপত্তা, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় এখানে আলোচিত হয়।
প্রাচীন সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে দুই বিশ্বযুদ্ধ, ঠাণ্ডাযুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বিশ্বায়ন ইত্যাদি ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসকে গঠন করেছে। ব্যারি বুজান ও রিচার্ড লিটলের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে সুমেরীয় শহরগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শুরু। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। আন্তর্জাতিক ধারণা বা আন্তর্জাতিকতাবাদ (International idea) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই তার বৈদেশিক নীতি বদলেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের মতাদর্শিক ঝোঁক বর্তমানে নেই। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উন্নত দেশসমূহ, জাপান ও চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ভারতের সাথে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত বাণিজ্য, গঙ্গার পানি, বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা, সমুদ্র সীমা ইত্যাদি বিষয়ে দু'দেশের মধ্যে বিবাদ দেখা দিয়েছে। ১৯৭২ সালের মৈত্রীচুক্তি মেয়াদ শেষে আর বৃদ্ধি করা হয়নি। গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন একটি জটিল বিষয়। তিস্তা নদীর পানির ভাগাভাগি প্রশ্নে ২০১১ সালে চুক্তি স্বাক্ষর ব্যর্থ হয়।
পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে দ্বন্দ্ব রয়েছে। পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের দাবি বিবাদের কারণ। ১৯৭১-এর যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার ও দন্ডদান নিয়ে সম্পর্ক আরও শীতল হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানির কারণে। রাশিয়ার সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা রয়েছে, যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আরব দেশগুলির সাথে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক সংগঠন:
বাংলাদেশ জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, সার্ক, বিমসটেক ও ওআইসির সদস্য। ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান করে এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। সার্কের ধারণা বাংলাদেশ তুলে ধরে।
ভূমিস্বত্ব সম্পর্ক:
বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা ইতিহাস জুড়ে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীনকালে রাজা, চাষি কিংবা গ্রামের জনসমাজ জমির মালিক ছিল বলে মনে করা হয়। মুগল আমলে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ধারণা ছিল, কিন্তু জমিদার, তালুকদার ও লাখেরাজদার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) জমিদারদের মালিকানা স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ আইন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে এবং রায়তদেরকে মালিক ঘোষণা করে। ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নে সমস্যা ছিল। আদিবাসীদের ভূমিস্বত্ব ও তাদের অধিকার নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।