বাংলার ভাস্কর্য: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
ভাস্কর্য, ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের অন্যতম প্রধান শাখা। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভাস্কর্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাস্কর্যের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ, যা বিভিন্ন কালের শিল্পরীতি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রতিফলন বহন করে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, গুপ্ত যুগ, পাল-সেন যুগ এবং পরবর্তী যুগের ভাস্কর্য শিল্পের বিভিন্ন দিক এই লেখায় আলোচনা করা হবে।
- *প্রাচীন যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক - খ্রিস্টীয় ৩য় শতক):** এই সময় বাংলায় মূলত পোড়ামাটির ভাস্কর্যের প্রচলন ছিল। পোড়ামাটির মূর্তিগুলির মাধ্যমে সেই সময়ের জনজীবন ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ছবি উঠে আসে। উত্তর-মধ্য ভারতে পাথরে খোদাইকৃত মূর্তির প্রচলন থাকলেও বাংলায় তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। সম্প্রতি চন্দ্রকেতুগড় ও মঙ্গলকোট থেকে আবিষ্কৃত কাঠ ও হাড়ের খোদাইকৃত ক্ষুদ্র মূর্তিগুলি সেই যুগের শিল্প ধারার কিছু ইঙ্গিত প্রদান করে।
- *কুষাণ যুগের প্রভাব (খ্রিস্টীয় ১য়-৩য় শতক):** কুষাণ যুগে মথুরা শিল্প কেন্দ্রের প্রভাব বাংলায় প্রতীয়মান হয়। লাল বেলেপাথরে নির্মিত বুদ্ধ ও কার্তিক মূর্তি এই যুগের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই মূর্তিগুলি আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
- *গুপ্ত যুগ (খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতক):** এই যুগে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি ও সৌন্দর্য বর্ণনার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বিষ্ণু মূর্তি এই যুগের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। গুপ্ত কালের ভাস্কর্য শিল্পে নমনীয়তা ও রেখার কমনীয় প্রকাশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- *পাল-সেন যুগ (৮ম-১২শ শতক):** পাল ও সেন রাজাদের শাসনামলে বাংলার ভাস্কর্য শিল্প স্বর্ণযুগ অর্জন করে। পাথর ও ব্রোঞ্জ উভয় মাধ্যমেই বুদ্ধ, বিষ্ণু, দুর্গা প্রভৃতি মূর্তি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়। পাহাড়পুর বিহারের ভাস্কর্যগুলি এই যুগের উল্লেখযোগ্য অবদান। ময়নামতী থেকে আবিষ্কৃত ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি ও এই যুগের অসাধারণ কর্ম। ঝেওয়ারী ব্রোঞ্জ বুদ্ধ মূর্তি এই যুগের উল্লেখযোগ্য অন্য একটি উদাহরণ।
- *মধ্যযুগের পরবর্তী সময় (১৩শ শতকের পর):** এই সময় মুসলিম শাসনের প্রভাব বাংলার ভাস্কর্য শিল্পে প্রভাব ফেলে। তবে সেন রাজাদের অধীনে ভাস্কর্য শিল্পের অবদান অব্যাহত থাকে। এ সময় শিব-নটরাজ মূর্তি প্রচলিত হয়।
এই লেখায় উল্লেখিত ভাস্কর্যগুলির অধিকাংশই বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলি শুধু বাংলার শিল্প ঐতিহ্যের প্রমাণ নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।