সরাইল উপজেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক এলাকা
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সরাইল উপজেলা একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এলাকা। ২১৫.২৮ বর্গ কিলোমিটার (৫৩,১৯৬ একর) আয়তনের এই উপজেলা ২৪°০০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই উপজেলার উত্তরে নাসিরনগর, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, পূর্বে বিজয়নগর ও আশুগঞ্জ এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী, কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও বাজিতপুর উপজেলা অবস্থিত। মেঘনা, তিতাস ও লাহুর নদী উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে।
নামকরণের ইতিহাস:
সরাইল নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। একটি মতে, ‘সর’ অর্থ সরোবর বা হ্রদ এবং ‘আইল’ অর্থ বাঁধ বা উঁচু ভূমি। অর্থাৎ, প্রাচীনকালে এটি ছিল বিশাল জলাশয়, যেখানে ধীরে ধীরে চর পড়ে জমি তৈরি হয়। অন্য একটি মতে, ‘সরাইখানা’ অর্থ ক্ষণস্থায়ী বসতি এবং ফার্সী ‘ঈল’ অর্থ বিদ্রোহী বন্ধু। ‘সরাই+ঈল’ মিলিত হয়ে ‘সরাইল’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের দেহরক্ষী বাহরাম খানের বিদ্রোহের স্থান হিসেবেও সরাইলের নাম উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
সরাইলের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। মোগল আমলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরগণা ছিল। বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর জন্ম ১৫২৯ সালে সরাইল পরগণায়। তিনি স্বাধীনভাবে জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন এবং তার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সরাইল। মুক্তিযুদ্ধে সরাইলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের সাক্ষী এই এলাকা। বিটঘরে ৭০ জন নিরীহ মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছিল।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
উপজেলার আয়তন ২১৫.২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫৪,৪৮১ জন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩,১৫,২০৮ জনে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,৪৬৪ জন। সাক্ষরতার হার ৪০.৯%।
অর্থনীতি ও উন্নয়ন:
সরাইলের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। প্রায় ৬৮% লোক কৃষিকাজে জড়িত। মৎস্যজীবী ও অন্যান্য পেশার লোকজনও রয়েছে। এখানে ময়দাকল, বরফকল, ইটভাটা, ওয়েল্ডিং কারখানা ইত্যাদি ছোটোখাটো শিল্পকারখানা রয়েছে। সরাইলের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ হলো গ্যাস। কুট্টাপাড়া এলাকায় তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রের খনন কাজ চলছে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
সরাইলের শিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠিত ১৮৭১), সরাইল কলেজ (১৯৭০) উল্লেখযোগ্য। সরাইলের সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। সরাইল মোরগ লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত, যা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে।
উপসংহার:
সরাইল উপজেলা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত একটি অসাধারণ এলাকা। আগামী দিনে উন্নয়নের মাধ্যমে সরাইল আরও সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়।