শালবন: একটি বহুমুখী পরিচয়
'শালবন' শব্দটি দুটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। এক্ষেত্রে দ্ব্যর্থতা দূর করার জন্য প্রথমে শব্দটির দুটি প্রধান ব্যবহার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন:
১. শালগাছ প্রধান বনভূমি:
এটি এক ধরণের বনভূমি যেখানে শালগাছ (Shorea robusta) প্রধান উদ্ভিদ। এ ধরণের বন গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র পত্রঝরা বনাঞ্চলের (Tropical Moist Deciduous Forest) অন্তর্গত। শালবনের বিস্তৃতি ভূ-প্রকৃতি, ভূতাত্ত্বিক গঠন, জলবায়ু ও মৃত্তিকার ধরণের উপর নির্ভর করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, হিমালয়ের পাদদেশব্যাপী আসাম থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত, মধ্য ভারতের কয়েকটি জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায় শালবন বিস্তৃত। ভারতে প্রায় ১৩০ লক্ষ হেক্টর, বাংলাদেশ ও নেপালে ১০ লক্ষ হেক্টরের বেশি এলাকা শালবনে আবৃত। বাংলাদেশে শালবন প্রায় ১,২১,০০০ হেক্টর (দেশের মোট বনভূমির ৩২%), গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় (ভাওয়ালের গড় ও মধুপুরের গড় নামে পরিচিত) বেশি। মধুপুরের গড় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মাঝে ৯৬ কিমি দীর্ঘ ও ৮-২৪ কিমি চওড়া। কুমিল্লা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও রাজশাহীতেও ছড়ানো শালবন আছে।
শালগাছ (২৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা) শীতকালে পাতা ঝরে ফেলে। এর কাঠ শক্ত ও টেকসই, বাড়িঘর, খুঁটি, নৌকা, রেলের স্লিপার, ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শালগাছের আঠা (শাল দামার, রাল, ধুম) নৌকার ছিদ্র বন্ধ, কার্বন পেপার, টাইপরাইটারের ফিতা, বার্নিশ, রং তৈরিতে কাজে লাগে। এর বীজ থেকে ভোজ্য তেল, শুকনো ফলের গুঁড়া আমাশয়ের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উপজাতীয়রা চালের পিঠা তৈরিতে পাতা ব্যবহার করে। শালবনে আরও ৫০০ প্রজাতির গাছপালা আছে (পলাশ, জারুল, বহেড়া, হরীতকী ইত্যাদি)। অতিমাত্রায় সম্পদ আহরণ, গাছ কাটা, অবিবেচিত উদ্ভিদ সংগ্রহের ফলে শালবন অবক্ষয়ের মুখোমুখি। এখানকার উপজাতীয়দের জীবন ও জীবিকা বনের উপর নির্ভরশীল; উল্লুকসহ অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
২. শালবন বৌদ্ধ বিহার:
এটি কুমিল্লা জেলার ময়নামতির লালমাই পাহাড়ে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ১২শ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসাবে চিহ্নিত এ বৌদ্ধ বিহার ৭ম-১২শ শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয় দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব ৮ম শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। বিহারটি আয়তকার, প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ, দেয়াল ৫ মিটার পুরু। ১৫৫ টি কক্ষ, একটি কেন্দ্রীয় মন্দির, প্রবেশদ্বার, রান্নাঘর ইত্যাদি ছিল। খননে আটটি তাম্রলিপি, ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, টেরাকোটা, মূর্তি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। বিহারের আশেপাশে একসময় শালগাছের ঘন বন ছিল বলে এর নাম শালবন বিহার রাখা হয়েছে।
উপসংহার:
'শালবন' শব্দটির দুটি প্রধান অর্থ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রসঙ্গানুসারে দ্ব্যর্থতা দূর করা জরুরি।