রাজস্ব

রাজস্ব: বাংলাদেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ

বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোতে রাজস্বের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘রাজস্ব’ (Government revenue বা national revenue) বলতে কর এবং কর-বহির্ভূত উৎস থেকে সরকারের অর্জিত অর্থকে বোঝায়, যা দিয়ে বিভিন্ন সরকারি ব্যয়ের বিধান করা হয়। এটি সরকারি বাজেটের মূল উপাদান এবং সরকারের আর্থিক নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। রাজস্ব আদায় একটি সরকারের সবচেয়ে প্রাথমিক দায়িত্ব, কারণ এর অভাবে সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও আইন প্রয়োগ অসম্ভব। রাজস্বের এই চাহিদাই আধুনিক রাষ্ট্রের বিকাশের এক প্রধান চালিকাশক্তি ছিল।

রাজস্ব, সরকারের ঋণ এবং অর্থ সৃষ্টি থেকে পৃথক। ঋণ ও অর্থ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার অর্থের যোগান সাময়িকভাবে বাড়াতে পারে কিন্তু রাজস্ব বৃদ্ধি হয় না। বার্ষিক বাজেটে সরকার চলতি ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে।

রাজস্বের উৎস:

কর রাজস্ব: আধুনিক যুগে কর রাজস্ব সরকারের রাজস্বের প্রধান উৎস। ওইসিডি কর্তৃক স্বীকৃত করের ধরণের মধ্যে আছে আয়কর (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর), পুঁজিবৃদ্ধি কর, সামাজিক নিরাপত্তা অবদান, বেতনকর, সম্পত্তিকর (সম্পদ কর, উত্তরাধিকার কর, উপহার কর), এবং পণ্য ও সেবা কর (মূল্য সংযোজন কর, বিক্রয় কর, অভ্যন্তরীণ শুল্ক, শুল্ক)।

কর-বহির্ভূত রাজস্ব: এর মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্পোরেশনের আয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয়, জরিমানা, সম্মানী, সম্পদ বিক্রয়, এবং বৈদেশিক সাহায্য (বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য)।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা:

বেশিরভাগ সরকারের একজন অর্থমন্ত্রী থাকেন যিনি রাজস্ব দেখাশোনা করেন। সরকারের একটি পৃথক রাজস্ব বিভাগও থাকতে পারে। বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই দায়িত্ব পালন করে। এনবিআর প্রত্যক্ষ (আয়কর, সম্পত্তিকর) ও পরোক্ষ কর (মূসক, শুল্ক, আবগারী) আদায় করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

ঔপনিবেশিক আমলে রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজস্ব বোর্ড গঠন করা হয়। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭০ সালে কলকাতা ও পাটনায় রাজস্ব পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৩ সালের কর্নওয়ালিস কোড রাজস্ব বোর্ডের কাঠামো সংশোধন করে। ১৯৭৩ সালে রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত হলে এর কাজ এনবিআরের উপর ন্যস্ত হয়। রাজস্ব জরিপ ও বন্দোবস্তের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ভূমি রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

রাজস্ব নীতি:

রাজস্ব নীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজস্ব নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি, এবং আয়ের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রাজস্ব নীতি প্রণয়নে প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯০-এর দশকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তন, কর ব্যবস্থার সংস্কার, এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নতিকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। বর্তমানে, সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর জোর দিচ্ছে এবং মধ্যম মেয়াদি বাজেটারি ফ্রেমওয়ার্ক (MTBF) বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

সাম্প্রতিক অগ্রগতি:

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, কর ব্যবস্থার সরলীকরণ, অটোমেশন, এবং করদাতা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন এই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, পরোক্ষ করের উপর অত্যধিক নির্ভরতা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে করের আওতা আরও বৃদ্ধি করা, আয়কর ও কর্পোরেট করের গুরুত্ব বাড়ানো, এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা।

উপসংহার:

রাজস্ব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এনবিআরের কার্যক্রম, রাজস্ব নীতি এবং সাম্প্রতিক সংস্কারগুলি দেশের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, কর ব্যবস্থার ন্যায়সঙ্গততা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রয়োজন।

মূল তথ্যাবলী:

  • রাজস্ব হল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস।
  • কর এবং কর-বহির্ভূত উৎস দুটোই রাজস্বের অংশ।
  • জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা করে।
  • রাজস্ব নীতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • সাম্প্রতিক সংস্কারে কর ব্যবস্থা সরলীকৃত হয়েছে।