বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের আমদানি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।
প্রাথমিক পর্যায়: স্বাধীনতার প্রথম দু-তিন বছর বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানি আয় ছিল মজুতের প্রধান উৎস। ১৯৭৪ সালে প্রবাসীদের রেমিটেন্স স্কিম চালু হলে মজুতের একটি নতুন উৎস যুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সাহায্য পেয়ে আসছে।
রপ্তানি ও বহুমুখীকরণ: বাংলাদেশ ধীরে ধীরে রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানি বাজারের বিস্তার করে। নতুন বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মজুতের প্রধান উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
উত্থান-পতন: ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশের মজুতের পরিমাণ আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক দায় পরিশোধ, এবং বিদেশে অর্থ প্রেরণের চাহিদার তুলনায় কম ছিল। ১৯৮১-৮২ সালে মজুতের পরিমাণ সর্বনিম্ন ১২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে যায়, যা এক মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়েও কম ছিল। এর কারণ ছিল রপ্তানি পণ্যের মূল্য হ্রাস, আইএমএফ কর্তৃক সাহায্য স্থগিত, এবং বৈদেশিক সাহায্যের হ্রাস। তবে ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে মজুতের পরিমাণ ৩.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায়, যদিও ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে।
ভাসমান বিনিময় হার: ২০০৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশ তার মুদ্রাকে ভাসমান ঘোষণা করে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর কাছে চলে যায়।
বর্তমান অবস্থা: ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, যা প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের ক্ষমতার সমান। মজুত বহুমুখীকরণের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে এবং উন্নত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে মজুত জমা রাখা হয়। বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে মজুত বেশ কয়েকটি দেশের মুদ্রায় সংরক্ষণ করা হয়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক সাবধানতা অবলম্বন করে এবং ক্ষতি এড়াতে সফল হয়।
সিদ্ধান্ত: বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ইতিহাস উত্থান-পতনের ইতিহাস। রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিটেন্স, এবং সাবধান ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মজুতের পরিমাণ উন্নত করেছে। তবে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে মজুতের পরিমাণে ওঠানামা হতে পারে। সুতরাং, স্থিতিশীল অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধির জন্য সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলের সঠিক বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।