বৈদেশিক মুদ্রা

বৈদেশিক মুদ্রা: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

মুদ্রা হলো পণ্য ও সেবার বিনিময়ের মাধ্যম। এটি অর্থের একটি রূপ, যা বিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি দেশ বা অঞ্চল যেখানে নির্দিষ্ট একটি মুদ্রা ব্যবহৃত হয় তাকে মুদ্রা এলাকা বলা হয়। অধিকাংশ দেশে সরকারই তাদের নিজস্ব মুদ্রার যোগান ও উৎপাদনে একচেটিয়া অধিকার রাখে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো।

একটি দেশের মুদ্রা যোগানের দুটি প্রধান উৎস হলো প্রচলিত মুদ্রা (কাগজের টাকা ও কয়েন) এবং ব্যাংক জমা। প্রচলিত মুদ্রার ইতিহাস প্রায় ১০,০০০ BCE থেকে শুরু। প্রাথমিকভাবে সোনা বা রূপার মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি মুদ্রা ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই 'রাজ-আজ্ঞা অর্থমুদ্রা' (fiat money) ব্যবহৃত হয়, যার মূল্য সরকার দ্বারা নির্ধারিত।

  • *আদিম প্রচলিত মুদ্রা:** প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (সুমের) শস্যের মজুতকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রথমে প্রতীক ব্যবহার করা হত। পরবর্তীতে, ধাতু, বিশেষ করে রূপা ও সোনা, মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হতে থাকে। তামারও ব্যবহার ছিল। এই তিন ধরণের ধাতুর মুদ্রা প্রাচীন ভারতেও মহাজনপদ আমলে প্রচলিত ছিল।
  • *কাগজী মুদ্রা:** প্রাক্-আধুনিক চীনে বৃহৎ লেনদেনে সুবিধার জন্য কাগজী মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়। এটি আধুনিক ব্যাংক নোটের পূর্বরূপ।
  • *ব্যাংক নোট ও পলিমার মুদ্রা:** বর্তমানে, ব্যাংক নোট (বিলে) প্রচলিত মুদ্রার একটি প্রধান অংশ। অস্ট্রেলিয়া ১৯৮০ সালে বিশ্বের প্রথম পলিমার মুদ্রা তৈরি করে, যা জালিয়াতি রোধে সহায়ক। ISO 4217 কোড ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সনাক্ত করা হয় (যেমন, USD যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের জন্য)।
  • *বৈদেশিক মুদ্রা বাজার:** বৈদেশিক মুদ্রা বাজার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন সহজ করে। বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালের পর বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের উন্নয়ন দ্রুতগতিতে হয়েছে। এর পূর্বে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক মুদ্রা বাজার পরিচালনা করত। স্বাধীনতার পর প্রথমে টাকার মান ভারতীয় মুদ্রার সাথে সমান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পরে বারবার অবমূল্যায়ন করা হয়। ১৯৭৬ সালে নিয়ন্ত্রিত ফ্লোটিং বিনিময় মুদ্রা নীতি চালু হয়। বিভিন্ন পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা (যেমন, ট্রেড ওয়েটেড বাস্কেট) পরে ১৯৯৩ সালের ১৭ জুলাই মুদ্রা রূপান্তরযোগ্যতার প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর ফলে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের উন্নয়ন ঘটে এবং কার্ব মার্কেটের প্রভাব কমতে থাকে। ২০০৩ সালের মে মাস থেকে ভাসমান বিনিময় হার চালু হয়।
  • *বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ:** বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা লাঘবের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ সংরক্ষণ করে। রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের রেমিটেন্স, এবং আন্তর্জাতিক ঋণ সুবিধার মাধ্যমে এ মজুদ বৃদ্ধি পায়। আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক দায় পরিশোধ, এবং বিদেশে ব্যয় নির্বাহের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত আমদানি নীতি অনুসরণ করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সীমিতভাবে বণ্টন করেছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও উদারীকরণের সাথে সাথে নীতিগুলো পরিবর্তিত হয়। ১৯৮১-৮২ সালে সর্বনিম্ন মজুদ ১২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, যা এক মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৪৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, যা প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট।
  • *উপসংহার:** বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, মুদ্রার রূপান্তরযোগ্যতা ও ভাসমান বিনিময় হার প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। তবে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মোকাবেলায় সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।

মূল তথ্যাবলী:

  • ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ব্যাপক উন্মুক্তকরণ শুরু হয়।
  • ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশি টাকার ভাসমান বিনিময় হার চালু হয়।
  • বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ব্যবস্থাপনা করে।
  • রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স এবং আন্তর্জাতিক ঋণ সুবিধা বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস।
  • বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক দায় পরিশোধ এবং অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।