বাহাদুর শাহ পার্ক: ঐতিহাসিক স্মৃতি ও আধুনিক রূপান্তর
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীবাজার এলাকায় অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক, শুধু একটি উদ্যান নয়, বরং ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের এক জীবন্ত সাক্ষী। এই পার্কের ইতিহাস বহু শতাব্দী ধরে বিস্তৃত, বিভিন্ন নাম, রূপান্তর ও ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে এটি আজকের আধুনিক রূপে উপস্থিত।
প্রাথমিক ইতিহাস:
আঠারো শতকের শেষের দিকে, বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের স্থানে ছিল ঢাকার আর্মেনীয়দের একটি বিলিয়ার্ড ক্লাব, যা স্থানীয়ভাবে ‘আন্টাঘর’ নামে পরিচিত ছিল। এই ক্লাবের সাথে সংলগ্ন মাঠটি ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে পরিচিত ছিল। এই ময়দান ১৮৪০ সালে বৃত্তাকার একটি বাগান হিসেবে জেমস টেলরের বর্ণনায় উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজরা এটি কিনে নিয়ে একটি পার্কের রূপ দেন, চারদিকে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরাও করেন এবং চার কোণায় কামান স্থাপন করেন। ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ এই ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি:
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়, আন্টাঘর ময়দান একটি ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয়। বিদ্রোহ দমনের পর, অনেক সিপাহীকে এখানে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তাদের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই ঘটনা ঢাকাবাসীর মনে গভীর ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণের ঘোষণা এখানেই প্রকাশ করা হয় এবং এই মাঠের নাম হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।
বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ:
১৯৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের শতবর্ষ উপলক্ষে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডিআইটি) এর উদ্যোগে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয় এবং পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নামানুসারে এই নতুন নামকরণ করা হয়। এই নামকরণে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।
বর্তমান অবস্থা:
বাহাদুর শাহ পার্ক আজ একটি ডিম্বাকৃতির উদ্যান, লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা এবং দুটি প্রধান ফটক রয়েছে। পার্কের ভেতরে পাকা রাস্তা, বসার স্থান, সবুজ গাছপালা এবং স্মৃতিসৌধগুলো আধুনিকায়ন করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এর উদ্যোগে পার্কের ব্যাপক সংস্কার করা হয়।
অবস্থান ও গুরুত্ব:
পার্কটি সদরঘাটের কাছে অবস্থিত এবং ৭টি রাস্তার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর আশেপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ইসলামিয়া হাই স্কুল, সরকারি মুসলিম স্কুল, সেন্ট থমাস চার্চ, ঢাকার জজ কোর্ট, বাংলা বাজার, ইসলামপুর এবং শাখারী বাজার সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। এই অবস্থানের কারণে পার্কটি পুরান ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত।
রক্ষণাবেক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ:
যদিও পার্কটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে, তবুও এর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ। নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা এবং অবৈধ দখলের মতো সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
উপসংহার:
বাহাদুর শাহ পার্ক ঢাকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য অংশ। এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে อนุรักษ์ করা জরুরি।