পূর্বাচল: একটি অধরা স্বপ্ন
পূর্বাচল, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রস্তাবিত রাজ্যের নাম যা ইতিহাসের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে। ভারত বিভাগের পর, অসমের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার জন্য এবং অসমীয়া ভাষাভাষীদের বাইরে অবস্থিত বাঙালি-প্রধান অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে এই পৃথক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব উঠে আসে। ১৯৪৮ সালে প্রথমবারের মতো পূর্বাচলের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির মাধ্যমে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে পুনরায় প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
প্রস্তাবিত পূর্বাচল রাজ্যে অসমের কিছু পাহাড়ি ও সমতল জেলা, সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং মণিপুর, ত্রিপুরা সহ আরও কিছু অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। স্বাধীনতার পর অসমে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের আশঙ্কা ও সিলেট এবং পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের পুনর্বাসনের প্রসঙ্গে এই প্রস্তাব আরও জোরালো হয়ে ওঠে। অধ্যাপক যোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী ছিলেন এই আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যিনি শিলঙ, কাছাড়, নওগাঁ, শিবসাগরের কিছু অংশ, সাদিয়া, বালিপাড়া, তিরাপ, লখিমপুর এবং মণিপুর, ত্রিপুরা ও কোচবিহারের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে তীব্র যুক্তি উপস্থাপন করেন।
তবে মণিপুরের নেতৃবৃন্দ এই প্রস্তাবে স্পষ্ট বিরোধিতা করে। তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে পূর্বাচল গঠনের ফলে মণিপুরের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় হারিয়ে যাবে। মণিপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তীব্র প্রতিবাদে এবং ২১ সেপ্টেম্বর হিজাম ইরাবত সিংহের নেতৃত্বে এক আন্দোলনের পর, মণিপুর রাজ্য পরিষদ মণিপুর কৃষক সভা ও মণিপুর সোশালিস্ট পার্টি কে বেআইনি ঘোষণা করে এবং ইরাবত সিংহের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ইরাবত সিংহ পরে পলায়ন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারও পূর্বাচল প্রস্তাবকে অবাস্তব মনে করে এবং মণিপুরকে অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতো ভারতের সাথে চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়।
১৯৫৪ সালে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষ থেকে পুনরায় পূর্বাচলের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, কিন্তু সেটিও গৃহীত হয়নি। পূর্বাচলের দাবী পূর্ণ না হলেও কাছাড়ের বাঙালিরা অসম সরকারের ভাষা নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়, যা পরবর্তীতে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনে রূপ নেয়। পূর্বাচল থাকুক বা না থাকুক, এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।