বাংলাদেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি একটি জটিল ও বহুমুখী সমস্যা। ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইন, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সংশোধিত হলেও, এর প্রয়োগে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কারখানাগুলিতে অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির ফলে শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। রানা প্লাজা ধসের মতো ঘটনা এ সমস্যার ভয়াবহতার স্পষ্ট নিদর্শন।
শ্রম আইন ২০০৬ এর ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে অগ্নিকাণ্ডের সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সতর্কতার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা প্রায়শই পালিত হয় না। এই আইনে অগ্নিকাণ্ডের সময় বহির্গমনের বিকল্প পথ, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম, স্পষ্ট সতর্কতামূলক চিহ্ন, হুঁশিয়ারী সংকেত, অবাধ বহির্গমন পথ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, এই ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আইনের দ্বাদশ অধ্যায় শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত আঘাত বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তুলে ধরে। এই আইন অনুযায়ী, চারদিনের বেশি কাজ করতে অক্ষম হলে শ্রমিক ক্ষতিপূরণের অধিকারী। মালিককে আহত শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় চিকিৎসা খরচ বহন করতে হবে। ১৫১ ধারায় বলা হয়েছে, জখমের ফলে মৃত্যু হলে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান আছে। তবে এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয় এবং প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে পারে না।
শ্রম আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য শ্রম আদালত রয়েছে। কিন্তু মামলার সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিচার বিলম্বিত হয়। আরো শ্রম আদালত এবং বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুতীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা (ADR) উন্নত করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, মৌলিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ, জরিমানা বাড়ানো, এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধির মতো কিছু সংশোধন করা হলেও, শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।
শ্রম আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে ,মালিকদের এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতা বৃদ্ধি, শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং সুষ্ঠু শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গঠনে জোর দেয়া প্রয়োজন। শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনা বীমা, সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এই সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা সম্ভব।