টাঙ্গুয়ার হাওর: বাংলাদেশের মনোমুগ্ধকর জলাভূমি
বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওরের স্থানীয় নাম ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান (প্রথমটি সুন্দরবন), যা ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি রামসার কনভেনশনের অধীনে তালিকাভুক্ত হয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য:
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝর্ণা এসে হাওরে মিশেছে। ১৮টি মৌজার ৫১টি হাওর নিয়ে ১২,৬৬৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এটি জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। এর মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ বসতি ও কৃষিজমি। ৮৮টি গ্রাম এই হাওর এলাকার ভেতরে ও তীরে অবস্থিত।
জীববৈচিত্র্য:
একসময় গাছপালা, মাছ, পাখি ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের এক অপরিসীম ভাণ্ডার ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর। এখানে বিভিন্ন জাতের পাখি, স্থানীয় ও পরিযায়ী, বিচরণ করে। ২০১৯ সালের পাখিশুমারি অনুযায়ী এখানে ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল ও বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক। প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ, ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিও এখানে বাস করে। অধ্যাপক আলী রেজা খানের মতে, এখানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২’র বেশি প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০’র বেশি প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১০০০’র বেশি প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আবাস রয়েছে।
ঐতিহাসিক ঘটনা ও সংরক্ষণ:
১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয় এবং ৬০ বছরের ইজারাদারি বন্ধ হয়। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে হাওরের সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ জেলা প্রশাসনের অধীনে। আইসিইউএন ও সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) হাওরের সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পরিচালনা করছে।
অর্থনৈতিক কার্যকলাপ:
টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস হলো মৎস্য ও কৃষিকাজ। শীত মৌসুমে পানি কমে গেলে প্রায় ২৪ টি বিলের পাড় জেগে ওঠে এবং এখানে রবিশস্য ও বোরো ধান চাষ করা হয়। এ সময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
পর্যটন:
টাঙ্গুয়ার হাওর বর্তমানে পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য। বর্ষা মৌসুমে শত শত পর্যটক নৌকা ভ্রমণ করে। এটি পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
উদ্ভিদ:
হাওরের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে আছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল ইত্যাদি।
সংক্ষেপে:
টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের একটি মনোমুগ্ধকর জলাভূমি, যা জীববৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পর্যটন সম্ভাবনার জন্য বিখ্যাত। এর সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।