তাহিরপুর উপজেলা: সুনামগঞ্জের একটি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ উপজেলা।
তাহিরপুর উপজেলা সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি প্রশাসনিক এলাকা। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত লাউড়ের পাহাড়ের নামানুসারে পৌরাণিক লাউড় রাজ্যের সাক্ষী এই উপজেলা। এটি উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে মধ্যনগর উপজেলার সাথে সীমান্ত ভাগ করে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
তাহিরপুরের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পুরাকীর্তির মাধ্যমে জানা যায়, প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই অঞ্চল। রাজা ভগদত্তের উপরাজধানী লাউড় পাহাড়ে অবস্থিত ছিল বলে মনে করা হয়। মহাভারত যুদ্ধে নিহত রাজা ভগদত্তের পরে, তার বংশধররা লাউড় অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। ভাস্করবর্মন ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর পর সিলেটের ভৌগোলিক রূপরেখা পরিবর্তিত হলে, লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত হয়। দশম শতাব্দীতে লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তীয়া তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল সিলেট। রাজা বিজয় মাণিক্য দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে লাউড় রাজ্য শাসন করেন এবং পান্ডুয়ায় (বর্তমান পেরুয়া) একটি শাখা রাজ্য স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে রাজা দিব্য সিংহ লাউড়ে রাজত্ব করেন এবং রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তরিত করেন। মোগল আমলে রাজা গোবিন্দ সিংহ ও বিজয় সিংহের মধ্যে সংঘাত হয়, যার ফলে ঐতিহাসিক লাউড় রাজ্যের রাজধানী হলহলিয়ায় ধ্বংসাবশেষের সাক্ষী হয়। মহাকবি সঞ্জয়ের বাসস্থানও এই অঞ্চলে ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাহিরপুরের নামকরণ সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, স্থানীয় একজন মুসলিমান তাহির আলীর নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ করা হয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
তাহিরপুর উপজেলার আয়তন ৩১৫.৩৩ বর্গ কিমি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, জনসংখ্যা প্রায় ২১৫,২০০; পুরুষ ১১০,৫৫৫, মহিলা ১০৪,৬৪৫। মুসলিম ১৯৭,৪৪৫, হিন্দু ১৬,৯২১, এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও আছেন। গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে এখানে।
অর্থনীতি:
তাহিরপুর উপজেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। ধান, বাদাম, গম, সরিষা প্রধান কৃষি ফসল। মাছ, পাথর, বালি ও কয়লাও উল্লেখযোগ্য। ফাজিলপুরের চুনাপাথর খনি দেশ বিখ্যাত। হাওড়ের বোরো ধান ও মাছ প্রধান আয়ের উৎস। কৃষি ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী ও অন্যান্য কাজের মাধ্যমে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:
শিক্ষার হার ৩০.৪%; পুরুষ ৩৩.২%, মহিলা ২৭.৫%। দুটি কলেজ, একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র এবং উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে।
যোগাযোগ:
পাকা ও কাঁচা রাস্তার মাধ্যমে তাহিরপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত। নৌপথও রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য স্থান:
টাঙ্গুয়ার হাওর, বিভিন্ন বিল, পণাতীর্থ বারুণী মেলা ও শাহ আরেফিন মেলা উল্লেখযোগ্য।
তাহিরপুর উপজেলা একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপজেলা। এটি এর ঐতিহাসিক স্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত।