বাংলাদেশের শিল্পায়নের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের শিল্পায়নের ইতিহাস বহু শতাব্দী পুরোনো। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাম্রলিপ্তি ছিল একটি প্রধান বন্দরনগরী, যার সাথে দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, পারস্য উপসাগর এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এ সময় বস্ত্রশিল্প, চিনি শিল্প, লবণ শিল্প, গজদন্ত শিল্প এবং ধাতু শিল্প উন্নত ছিল। আট শতকে আরব বণিকরা চট্টগ্রামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ থেকে ঢাকার মসলিন বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। ৫০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেও বস্ত্র, চিনি, লবণ ও অলঙ্কার রপ্তানি হতো। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটে। তবে, ১৭ শতক পর্যন্ত উৎপাদন কার্যক্রম কয়েক প্রকার দ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
মুগল আমল: মুগল আমলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর আগমনের ফলে বাংলায় উৎপাদন ক্ষেত্রে ত্বরান্বিত বিকাশ ঘটে। রপ্তানি বাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ শিল্প উন্নয়নে নতুন প্রেরণা যোগায়। মুদ্রার প্রসার, মূলধন গঠন প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার ফলে নতুন বাজার ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। চরকাকার, তাঁতি, সূত্রধর এবং কুম্ভকার প্রভৃতি কারিগর শ্রেণির অবদান উল্লেখযোগ্য ছিল। সূক্ষ্ম বস্ত্র, চিনি, লবণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, ধাতু নির্মিত দ্রব্যাদি, অস্ত্রশস্ত্র, তামার ছাঁচ, গজদন্ত ভাস্কর্য, কাঠের কারুকাজ, সূচিশিল্প, অলঙ্কার ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটিশ আমল: ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলার বস্ত্রশিল্প সম্পূর্ণ কুটিরশিল্প নির্ভর ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দাদনি প্রথা চালু করে কারিগরদের ঋণ দিত, যা কালক্রমে অত্যাচারমূলক হয়ে ওঠে। ১৭৭৬ সালে ঢাকা জেলায় বস্ত্রশিল্পে ১৪৬৭৫১ জন তাঁতি ছিল। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, মিদনাপুর, নদীয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বস্ত্রশিল্প সমৃদ্ধ ছিল। শিল্প বিপ্লব ও ব্রিটিশদের শুল্ক নীতির কারণে এই শিল্প ধ্বংস হয়। ব্রিটিশরা রেশম শিল্পের দিকেও নজর দেয়, মুর্শিদাবাদ (বর্তমান রাজশাহী) ছিল রেশম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। কলকাতায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটে। লবণ ও চিনি শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হয়, কিন্তু ব্রিটিশ নীতির কারণে দেশীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাকিস্তান আমল: ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান অবিভক্ত বাংলার শিল্পের সামান্য অংশ পায়। পূর্ব পাকিস্তানে অদক্ষ অকৃষি শ্রমিক, উৎপাদনশীল শিল্পে নিয়োজিত দক্ষ শ্রমিক, এবং কুটিরশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল। পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন ও পাকিস্তান শিল্প অর্থসংস্থান করপোরেশন গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে পক্ষপাতিত্ব করা হয়।
বাংলাদেশ আমল: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ লোকসানী হয়। ১৯৮২ সালে নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। এর ফলে শিল্পরুগ্নতা দেখা দেয়। ১৯৮৪ সালে ৯,৩২,২০০ টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছিল। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন কুটির শিল্প ছিল। বস্ত্র, পাট শিল্প লোকসানে ভুগে। ১৯৮০-এর দশকে জাহাজ নির্মাণ, তৈরি পোশাক, প্রভৃতি শিল্প বিকাশলাভ করে। ১৯৯০ এর দশকে শিল্পখাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। বেসরকারীকরণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়। ২০০০ সালে রুগ্ন শিল্পের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯০ এর দশক থেকে সরকার শিল্পায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে।