হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম: এক ঐতিহ্যের সাক্ষী
হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহ্যের এক অমূল্য অংশ। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-১৭৫০ সালের সিন্ধু সভ্যতা থেকেই এর ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতার খননকার্যে হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন জীবজন্তু, চিরুনি, বোতাম ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে। বিহারের চম্পানগর, নাগড়া, মহেশ্বর প্রভৃতি স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ৫০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত কালের হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। ইরানের রাজা ১ম দারাউস (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬) তাঁর সুসা প্রাসাদ সাজাতে এটি ব্যবহার করেছিলেন। গুজরাট, পাঞ্জাবের রূপায় ও সাঁচীস্তূপের শিলালিপি থেকেও প্রাচীনকালে এই শিল্পের প্রসারের প্রমাণ মিলে।
শূঙ্গযুগে (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক) ভারহূত, বোধগয়া ও সাঁচীস্তূপের তোরণ ও বেষ্টনীতে হাতির দাঁতের শিল্পীদের নিয়োগ করা হতো। কুষাণ যুগে তক্ষশীলা ও বেগ্রামে প্রচুর হাতির দাঁতের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতু গড়ে প্রসাধনী কাজে ব্যবহৃত হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশে হাতির দাঁতের ব্যবহারের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় সিলেট অঞ্চলে; এগারো শতকের ভাটেরা তাম্রলিপি সিলেটের শাসক নারায়ণপুত্র গোবিন্দ কেশবদেবের একজন হাতির দাঁতের শিল্পীকে নিয়োগের কথা উল্লেখ করে।
ভারতের বাইরে গ্রিক, ল্যাটিন, আরব ও চীনা সাহিত্যেও হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের উল্লেখ আছে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে উড়িষ্যা এই শিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। উড়িষ্যা, বিহার ও বাংলা অঞ্চলে এ শিল্প বেশ প্রসার লাভ করে। বাংলাদেশের সিলেট ও পশ্চিমবঙ্গের ইদিলপুরে দক্ষ কারিগরদের বাস ছিল। মুসলমানদের আগমনের পর হাতির দাঁতের তৈরি পায়া, কলমদান, পিঠ চুলকানি, হুক্কার নল, তরবারি ও ছোরার হাতল ইত্যাদি ব্যাপকতা লাভ করে। মুগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীতে কয়েকজন হাতির দাঁতের শিল্পীর উল্লেখ আছে। ষোল শতকে বিদেশী বণিকদের আগমনের পর বিদেশী শিল্পশৈলীর প্রভাব পড়ে।
ব্রিটিশ ভারতে ইউরোপ হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের প্রধান বাজার ছিল। ব্রিটিশরা আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত আনিয়ে ভারতীয় কারিগরদের দ্বারা শিল্পকর্ম তৈরি করিয়ে ইউরোপে রপ্তানি করত। লুধিয়ানা, পালি, জয়পুর, কেরালা, মহীশূর, আসাম ও বাংলায় এ শিল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণসহ সব বর্ণের হিন্দু ও মুসলমান এ কাজে নিয়োজিত ছিল। শুধু হাতির দাঁত নয়, ম্যামথ, জলহস্তী, সিন্ধুঘোটক, নরহোয়াল, দুগং, ধনেশ ও তিমির দাঁত ও হাড় ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে মাছ ও প্রাণীর হাড় দিয়ে হাতির দাঁতের অনুরূপ শিল্পকর্ম তৈরি হয়।
হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের যন্ত্রপাতি প্রায় কাঠের শিল্পকর্মের অনুরূপ। করাত, ছুরি, উখা, বাইস, স্ক্র্যাপার, বাটালি, হাতুড়ি, কম্পাস, তুরপুন, লেদ, লোহার কলম ও লেন্স ব্যবহার করা হয়। নির্মাণপদ্ধতি সনাতনী। দাঁতের মজ্জা পরিষ্কার করে, মোম দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে তারপর কাটা ও খোদাই করা হয়। সূক্ষ্ম কাজ লোহার কলম ও ড্রিল মেশিন দিয়ে করা হয়। শিল্পকর্ম মসৃণ করার জন্য কাগজ, হাতির দাঁতের গুঁড়ো, মাছের অাঁশ, চীনামাটি ও চক পাউডার ব্যবহার হয়। রঙ ব্যবহার করে শিল্পকর্মকে আরও আকর্ষণীয় করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে হাতির দাঁতের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে হাতির দাঁতের তৈরি একটি পাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এটি সিলেটে তৈরি এবং ঊনিশ শতকের। জাদুঘরে বলধা জমিদারের উপহার হিসেবে প্রাপ্ত হাতির দাঁতের শিল্পকর্মও সিলেটের তৈরি বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামে মাছ ও পশুর হাড় দিয়ে গলার মালা, খোপার কাঁটা, আংটি ইত্যাদি তৈরি হয়। ভারতে হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম নিষিদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন পশুপাখির হাড় দিয়ে অনুরূপ শিল্পকর্ম তৈরি হচ্ছে।