ভূমি

ভূমি: একটি বিস্তারিত আলোচনা

ভূমি, পৃথিবীর কঠিন বহিরাবরণ যা স্থায়ীভাবে পানিতে নিমজ্জিত থাকে না, মানবজাতির অস্তিত্ব ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। কৃষি, বসতি, প্রাকৃতিক সম্পদ— সবকিছুরই ভিত্তি ভূমি। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি রেকর্ড, প্রশাসন, সংস্কার—সবকিছুই এর ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সাথে জড়িত।

  • *ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:** প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা রাজতন্ত্র ও জমিদারি প্রথার সাথে জড়িত ছিল। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি লাভ করে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গীয় জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়।
  • *ভূমি ব্যবস্থাপনা:** খাজনা আদায় ছাড়াও, ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্তর্গত রয়েছে রেকর্ড হালনাগাদ, খাস জমির বন্দোবস্ত, প্রজাদের ভূমি শিকস্তি, ভূমিহীন কৃষকদের সাহায্য, কৃষি ঋণ প্রদান ইত্যাদি। রাজস্ব কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • *ভূমি রেকর্ড:** সরেজমিন জরিপের পর ভূমি রেকর্ড তৈরি হয়। কিশ্তওয়ার (মৌজা মানচিত্র প্রণয়ন), খানাপুরি (খসড়া খতিয়ান তৈরি), বুইহারাত (ব্যাখ্যা ও বোঝানো), তসদিক (যাচাই) প্রভৃতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে চূড়ান্ত খতিয়ান তৈরি হয়। বর্তমানে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
  • *ভূমি প্রশাসন:** ব্রিটিশ আমলে বোর্ড অব রেভিনিউ, পাকিস্তান আমলে রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট এবং স্বাধীনতার পর ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় ভূমি প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেছে। ১৯৮০ সালে ভূমি প্রশাসন বোর্ড, ১৯৮৯ সালে ভূমি আপিল বোর্ড ও ভূমি সংস্কার বোর্ড গঠিত হয়।
  • *ভূমি সংস্কার:** ১৯৪০ সালে ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ, ১৯৫০ সালের স্টেট অ্যাকুইজিশন আইন, ১৯৭২ সালের ভূমি মালিকানা (সীমিতকরণ) আদেশ, ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অর্ডিন্যান্স—এইসব ভূমি সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ভূমিসিলিং, কর রেওয়াতি, ভূমিহীনদের জমি বণ্টন প্রভৃতি এতে অন্তর্ভুক্ত।
  • *ভূমি জরিপ:** শেরশাহ, তোডর মলের সময়ে ভূমি জরিপের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থাকবস্ত, রাজস্ব, খসড়া, দিয়ারা, কিশত্ওয়ার (ক্যাডাস্ট্রাল) জরিপ, বিমান জরিপ, রিমোট সেন্সিং—বিভিন্ন জরিপ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
  • *ভূমি অবনয়ন ও মরুকরণ:** ক্ষয়, দূষণ, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা—এসব ভূমি অবনয়নের কারণ। উচ্চ ফলনশীল শস্য, অসামঞ্জস্য সার প্রয়োগ, বন উজাড়—এসবও ভূমি অবনয়নে অবদান রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের কর্মকাণ্ড মরুকরণের জন্য দায়ী।
  • *ভূমি ব্যবহার:** বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, প্লাবনসীমা—এসব ভূমি ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। কৃষি, বসতি, জলাভূমি, বন—এসব ভূমি ব্যবহারের প্রধান শ্রেণি।
  • *ভূমি অধিগ্রহণ:** জনসাধারণের কল্যাণে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বেসরকারি জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও দ্রুত করার চেষ্টা চলছে।
  • *ভূমি সম্পদ প্রযুক্তি:** কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভূমি ও মৃত্তিকা ভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। থানা নির্দেশিকার মাধ্যমে এ প্রযুক্তির ব্যবহার আরও সুষ্ঠু করা সম্ভব।

মূল তথ্যাবলী:

  • ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দীউয়ানি লাভ করে।
  • ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন।
  • ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়।
  • ভূমি ব্যবস্থাপনায় রেকর্ড হালনাগাদ, খাস জমির বন্দোবস্ত, কৃষকদের সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • ভূমি সংস্কারে ভূমিসিলিং, কর রেওয়াতি, ভূমিহীনদের জমি বণ্টন অন্তর্ভুক্ত।
  • ভূমি অবনয়ন রোধে সমন্বিত মৃত্তিকা ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।