বীর প্রতীক হাবিবুল আলম: ঢাকার গেরিলা যুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদান রেখেছেন বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বীর প্রতীক হাবিবুল আলম। তিনি ছিলেন ঢাকা শহরের গেরিলা যুদ্ধের একজন অবিস্মরণীয় নাম। ঢাকা শহরে গোপনে গেরিলা অপারেশন পরিচালনায় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন অত্যন্ত সাহসী ও দুঃসাহসী সদস্য ছিলেন তিনি।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা:
১৫ মে ১৯৫০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুল আলম। তার পৈতৃক বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পিরুলী গ্রামে। পিতা হাফিজুল আলম ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তিনি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গোপনে বাড়ি ছেড়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মতিনগরে যান এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মে মাসে ঢাকায় ফিরে আগস্ট মাস পর্যন্ত ঢাকা শহরে অবস্থান করে গোপনে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে হাবিবুল আলম ‘অপারেশন পেট্রল পাম্প’, ‘অপারেশন ফাইভ পাওয়ার সাবস্টেশনস’, ‘অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট’ ও ‘অপারেশন হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টাল’ সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সফলতার সাথে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার বাবা হাফিজুল আলম মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সহযোগিতা করতেন এবং তাঁর ঢাকার বাসাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। হাবিবুল আলমের তিন বোন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও অস্ত্রের যত্নে সহায়তা করেছিলেন।
ক্র্যাক প্লাটুন:
‘ক্র্যাক প্লাটুন’ ছিল ঢাকা শহরের গেরিলা যুদ্ধের একটি বিখ্যাত দল। এই দলটির সদস্যরা তাদের দুর্দান্ত সাহসিকতা ও যুদ্ধকৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাদের ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর ছিল। হাবিবুল আলম এই প্লাটুনের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বীর প্রতীক খেতাব:
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য হাবিবুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৫।
পরবর্তী জীবন:
মুক্তিযুদ্ধের পর হাবিবুল আলম তার নিজ গ্রাম পিরুলীতে ‘হাবিবুল আলম বীর প্রতীক মহাবিদ্যালয়’ নামে একটি কলেজ স্থাপন করেন। তিনি বিশ্ব স্কাউট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ স্কাউটস আন্তর্জাতিক কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সালে তিনি বিশ্ব স্কাউট আন্দোলনে ব্যতিক্রমী সেবার জন্য বিশ্ব স্কাউট সংস্থার ব্রোঞ্জ উলফ পুরস্কার লাভ করেন।
হাবিবুল আলমের জীবনী একজন মুক্তিযোদ্ধার সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বদা স্মরণীয় থাকবে।