রংপুর নগরী: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের প্রাণকেন্দ্র রংপুর নগর। ঐতিহ্যের সাক্ষী, সংস্কৃতির ধারক ও আধুনিকতার ছোঁয়া- এই তিনটিরই অপূর্ব সমন্বয়ে রচিত এই শহরটি দেশের উত্তরাঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ৭০০ বছরেরও অধিক ঐতিহ্যের ধারক এই শহরটি শতরঞ্জি, হাড়িভাঙ্গা আম, এবং তামাকের জন্য বিখ্যাত।
ইতিহাসের পাতায়:
রংপুর শহরের নামকরণের বেশ কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। কোনটি সঠিক তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিছু লোক মনে করেন ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে নামটি এসেছে। আবার অন্যদের মতে, মহাভারতের সময় প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রঙ্গমহল থেকে এই নামকরণ। অনেকে আবার বলেন, রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা থাকার কারণে এ নামকরণ। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর আমলে রংপুরের নাম রঙ্গপুর রাখা হয়েছিল। ১৭৬৫ সালে রংপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৭৬৯ সালে রংপুর শহর জেলার বিভাগীয় সদর দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৬৯ সালে রংপুর পৌরসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল আমলে রংপুর ঘোড়াঘাট সরকারের অধীনে ছিল। পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে এবং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়। ১৯৪৬ সালে উত্তরবঙ্গের কৃষকদের বৈঠক এবং তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয় রংপুরে। মুক্তিযুদ্ধেও রংপুরের অবদান অসামান্য।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
রংপুর জেলা ২৫°০৩˝ থেকে ২৮°২৮˝ অক্ষাংশে এবং ৮৮°৪৫˝ থেকে ৮৯°৫৫˝ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এর উত্তরে নীলফামারী ও লালমনিরহাট, দক্ষিণে গাইবান্ধা, পূর্বে কুড়িগ্রাম এবং পশ্চিমে দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। তিস্তা নদী রংপুরের উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে পৃথক করে। রংপুরের মোট আয়তন ২,৩০৮ বর্গকিলোমিটার। জেলাটিতে ৮টি উপজেলা, ৭৬টি ইউনিয়ন, ১৪৫৫টি মৌজা, ১টি সিটি কর্পোরেশন, এবং ৩টি পৌরসভা রয়েছে। রংপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৩১,৬৯,৬১৫।
অর্থনীতি:
রংপুরের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। ধান, পাট, আলু, তামাক, এবং বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম উৎপাদিত হয়। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যেমন বিসিক শিল্পনগরী, বিড়ি কারখানা, আরকে ফ্যান কারখানা, শ্যামপুর চিনিকল লিমিটেড, এবং রংপুর ডিস্টিলারিজ এন্ড কেমিক্যাল কোঃ লিঃ। ব্রিটিশ আমলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, যা আজও বজায় রয়েছে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
শিক্ষার দিক থেকে রংপুর অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ উল্লেখযোগ্য। রংপুরের সংস্কৃতিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। লোকসংস্কৃতি, ভাওয়াইয়া, আধুনিক ও রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত এখানে প্রচলিত। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে হাডুডু, কাবাডি, লাঠিখেলা উল্লেখযোগ্য।
পর্যটন:
রংপুরে পর্যটনের জন্য অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। তাজহাট জমিদার বাড়ি, ভিন্নজগৎ পার্ক, রংপুর চিড়িয়াখানা, ঘাঘট প্রয়াস পার্ক, চিকলি ওয়াটার পার্ক, বেগম রোকেয়ার বসতভিটা এবং অনেক পুরাতন মসজিদ ও মন্দির উল্লেখযোগ্য। তিস্তা নদীর সৌন্দর্যও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
উপসংহার:
ঐতিহাসিক গৌরব, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, এবং আধুনিক উন্নয়নের অপূর্ব মেলবন্ধনে রংপুর নগরী এক অনন্য পরিচয় বহন করে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি একটি আদর্শ গন্তব্য।