ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা: ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বর্তমান অবস্থা
ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ভালুকা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ধারে অবস্থিত এই উপজেলা একই সাথে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ৪৪৪.০৫ বর্গ কিমি আয়তনের এই উপজেলায় প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ বসবাস করে (২০১৯ সালের প্রাক্কলন)।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
ভালুকা উপজেলার অবস্থান ২৪°১৬´ থেকে ২৪°২৯´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°১৪´ থেকে ৯০°২৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উত্তরে ফুলবাড়ীয়া ও ত্রিশাল, দক্ষিণে শ্রীপুর (গাজীপুর), পূর্বে গফরগাঁও, এবং পশ্চিমে সখীপুর ও ঘাটাইল উপজেলা অবস্থিত। ২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ৪,৩০,৩২০ জন, যার মধ্যে পুরুষ ২,১৭,১৩৪ এবং মহিলা ২,১৩,১৮৬ জন। মুসলিম ৪,১০,৭৪৫, হিন্দু ১৭,৩৮১, বৌদ্ধ ৩৫, খ্রিস্টান ১৪৭৩ এবং অন্যান্য ৬৮৬ জন। গারো, রাজবংশী, মান্দাই প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাসও রয়েছে এখানে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
পাল ও সেন রাজবংশের আমলে ময়মনসিংহ ও ভালুকা সামন্ত শাসকদের অধীনে ছিল। ১৪ শতকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে এ অঞ্চল মুসলিম শাসনের আওতায় আসে। ইংরেজ শাসনের সময় ময়মনসিংহকে বিভিন্ন মহকুমায় ভাগ করা হয়, যার মধ্যে ভালুকাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৭ সালে ভালুকা থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে তা উপজেলায় উন্নীত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ভালুকায় মেজর আফসার উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধ, সিডস্টোর, চানপুর, মামারিশপুর, ভালুকা থানা, মল্লিকবাড়ী, চান্দেড়াটি ও পারাগাঁও-এ সংঘটিত যুদ্ধসমূহ উল্লেখযোগ্য।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
ভালুকা মূলত শিল্পের উপর নির্ভরশীল। অনেক টেক্সটাইল মিল, ঔষধ কারখানা, কুমির খামার, সিরামিক শিল্প, স্পিনিং মিল, কোমল পানীয় কারখানা, চালের মিল ইত্যাদি শিল্প কারখানা রয়েছে এখানে। কৃষি ও মৎস্য খাতও এখানকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধান কৃষি ফসলের মধ্যে ধান, পাট, গম, আখ, আলু, ডাল, সরিষা এবং বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উল্লেখযোগ্য। আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, লিচু, আনারস, কুল, আমড়া, জাম, জলপাই, পেঁপে, আতা, নারিকেল প্রধান ফল-ফলাদি।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:
শিক্ষার হার ৪৯.১%। এখানে ৫টি কলেজ, ৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কারিগরি স্কুলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবায় ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২টি হাসপাতাল, ৬টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, এবং ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।
বিশেষ আকর্ষণ:
উথুরা ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামের কুমির উৎপাদন কেন্দ্র, পাড়াগাঁও গ্রামের আরবীয় খেজুর চাষের খামার, হবিরবাড়ী ইউনিয়নের খরগোশ উৎপাদন কেন্দ্র, তেপান্তর ও প্যারাডাইস পয়েন্ট ভালুকার বিশেষ আকর্ষণ। কাদিগড় জাতীয় উদ্যান ভালুকায় অবস্থিত।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলী:
২০২৪ সালের শেষের দিকে ভালুকায় বেশ কিছু রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভালুকায় বিভিন্ন স্থানে হামলা, সহিংসতা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে।
আশা করা যায় ভালুকা ভবিষ্যতে আরও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।