বাংলা লোকসংগীত বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম মূল্যবান অংশ। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে প্রচলিত গানের সম্ভার, যা বাংলার গ্রামীণ জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মানুষের আবেগ-অনুভূতি, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহের প্রতিফলন। শতাব্দী ধরে এ গানগুলি বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছে, এবং এখনও জীবন্ত রয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলা লোকসংগীতের কোন নির্দিষ্ট সৃষ্টির তারিখ নেই। আদিম পাঁচালী গান থেকে শুরু করে, মহাভারত, রামায়ণ, ভাগবতের বাংলা অনুবাদ, নাথগীতি, বাউল গান, কীর্তন, আরও অনেক ধারা মিলে এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতকে গ্রামীণ গীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিকাশ ঘটে, পল্লীগীতির বিস্তার ঘটতে থাকে। বিংশ শতকে আকাশবাণী ও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে এই গানগুলি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ:
বাংলা লোকসংগীতের প্রসারে অবদান রাখা অনেক শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যায়। তাদের মধ্যে আছেন আব্বাসউদ্দীন, নায়েব আলী, গিরীন চক্রবর্তী, গৌরী কেদার চক্রবর্তী, অনন্তবালা, সুরেন চক্রবর্তী, মিস্ হরিমতি, পূর্ণদাস বাউল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর পাল, বিষ্ণুপদ দাস প্রমুখ। এছাড়াও অসংখ্য লোককবি, গায়ক, কথক এবং শিল্পী এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছেন।
বিভিন্ন ধারা:
বাংলা লোকসংগীত অনেক ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভাওয়াইয়া (উত্তরবঙ্গ), ভাটিয়ালি (পূর্ববঙ্গ), ঝুমুর (পশ্চিমবঙ্গ), সারি গান (দক্ষিণবঙ্গ), বাউল, মারফতি, কবিগান, গম্ভীরা, বিবাহ গীতি, ব্রত গীতি, শ্রম সংগীত ইত্যাদি। প্রতিটি ধারার নিজস্ব শৈলী, সুর, ও বিষয়বস্তু থাকে।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি:
বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এই গান প্রচলিত। তবে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব লোকসংগীতের ধারা থাকে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদী, গ্রামীণ পরিবেশ, কৃষিকাজ, দৈনন্দিন জীবন এই সব বিষয়ই এই গানের মূল বিষয়বস্তু।
বর্তমান অবস্থা:
আধুনিক সংগীতের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, বাংলা লোকসংগীত এখনও জীবন্ত রয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও এই ধারাকে জীবন্ত রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং প্রসারের জন্য আরও চেষ্টা প্রয়োজন।