বাংলাদেশে পুলিশি নির্যাতন: এক অন্ধকার বাস্তবতা
বাংলাদেশে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এ ধরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই নির্যাতন শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যদের দ্বারা নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য ব্যক্তিদের দ্বারাও সংঘটিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এমন ঘটনার সাথে জড়িত থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
- *উল্লেখযোগ্য ঘটনা:**
- **২০১৭ সালের ১৮ই জুলাই:** খুলনায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া পিরোজপুরের মোঃ শাহজালালের উপর পুলিশি নির্যাতনের ফলে তিনি দুই চোখ হারান। তার বাবা, মোঃ জাকির হোসেন এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
- **২০১৪ সাল:** ঢাকার মিরপুরের মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসেন রকি এবং তার ভাই পুলিশি হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতনের ফলে ইমতিয়াজের বড় ভাই মারা যান।
- **২০২৩ সালের অক্টোবর:** ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশি লাঠিচার্জে ৩৩ জন শিক্ষক আহত হন।
- **২০২৩ সালের ডিসেম্বর:** সিলেটের বন্দরবাজার থানায় পুলিশের হেফাজতে রায়হান আহমেদ নামে এক যুবকের মৃত্যু। পুলিশ গণপিটুনির কথা বললেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
- **২০১৯ সাল:** ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ সাত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
- **বিভিন্ন সময়ে:** বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের আন্দোলন, অন্যান্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রতিবাদে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অনেক মানুষ নিহত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এমন ঘটনার রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
- **জর্জিয়া (২০২৩):** জর্জিয়ার বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা।
- **মুন্সিগঞ্জ (২০২৪):** থানা হেফাজতে এক আসামিকে নির্যাতনের অভিযোগে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুজাহিদুল ইসলামসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা।
- *পুলিশি নির্যাতনের ধরন:**
রড, বেল্ট, লাঠি দিয়ে পেটানো, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ঝুলিয়ে পেটানো, ইচ্ছাকৃত গুলি (নীক্যাপিং), ক্রসফায়ারের নামে গুলি।
- *জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া:**
জাতিসংঘের নির্যাতন বন্ধ সংক্রান্ত কমিটি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করছে। বাংলাদেশ সরকার নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলি সেগুলি মানতে অনীহা প্রকাশ করেছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ 'কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার এন্ড আদার ক্রুয়েল, ইনহিউম্যান অর ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট' সনদ অনুমোদন করে।
- *আইন ও প্রতিকার:**
২০১৩ সালে 'টর্চার এন্ড কাস্টডিয়াল ডেথ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট' আইন পাস হলেও খুব কম মামলাই হয়েছে এবং সেগুলির বেশিরভাগই নিষ্পত্তি হয়নি।
- *উদ্বেগ ও সমাধান:**
পুলিশি নির্যাতন বন্ধে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন। আইনের প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা, তদন্তের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা, দোষীদের বিচার দান করা এবং পুলিশ সদস্যদের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে এই বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।