নেকমরদ: ঐতিহাসিক এক জনপদের কাহিনী
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার ৮ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত নেকমরদ, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। সম্ভবত ১২শ বা ১৩শ শতাব্দীর প্রথম দিকে সৈয়দ নাসিরুদ্দীন শাহ আউলিয়া নামে একজন পীরের আগমনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গে ইসলাম প্রচারের পর তিনি ভবানন্দপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং একটি খানকাহ স্থাপন করেন। তাঁর সৎস্বভাব, চরিত্রমাধুর্য ও ধর্মপরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাঁকে নেকবাবা, নেকমরদ, বা নেকমরদান নামে অভিহিত করে। পরবর্তীতে, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শনস্বরূপ ভবানন্দপুর গ্রামের নামকরণ করা হয় নেকমরদ।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা:
নেকমরদ ও এর আশপাশের প্রায় ১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রাচীন দিঘি, পুষ্করিণী এবং অসংখ্য ভগ্ন প্রত্নবস্তুর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। একাধিক প্রাচীন দুর্গ, পাথর ও ব্রোঞ্জের মূর্তি, এবং মাটির নিচে অসংখ্য প্রাচীন ইট ও ইমারতের ভিত্তি ইঙ্গিত করে যে, আদি মধ্যযুগে এখানে একটি সমৃদ্ধ জনপদের অস্তিত্ব ছিল। পীর শাহ নেকমরদ এখানেই সমাহিত আছেন, এবং তাঁর মাজারের কাছে একটি বৃহৎ জলাশয় রয়েছে, যেখানে প্রস্তর নির্মিত অনেক মূর্তি পাওয়া যায়। নেকমরদ উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণকালে ০.৬ মিটার মাটির নিচে একটি মৃৎপাত্রে রক্ষিত ১০টি ব্রোঞ্জ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। মাজার থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত জলাশয়ের পাড়ে প্রচুর গ্রানাইট ও কালো পাথরের সন্ধান পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
নেকমরদের মাজারের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আরও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনের অস্তিত্ব রয়েছে। মাজার থেকে প্রায় ১.৫ কিমি উত্তরে গড়গাঁও নামে একটি প্রাচীন ভগ্নদুর্গ এবং কয়েকটি বিশাল দিঘি অবস্থিত। মাজার থেকে ২.৫ কিমি দক্ষিণে কুমোরগঞ্জে একটি পাথর নির্মিত বিশাল কূপের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা বর্তমানে ভরাট হয়ে আছে।
প্রাচীন ইতিহাস:
উপযুক্ত তথ্যের অভাবে নেকমরদের প্রাচীন ইতিহাস সুস্পষ্ট নয়। তবে জনশ্রুতি ও প্রত্নসম্ভারের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে, ভীম ও পৃথু নামে দুজন শাসক এ অঞ্চল শাসন করতেন। তবে এ বিষয়ে সঠিক নিশ্চিততা নেই।
নেকমরদ মেলা:
অনুমান করা হয় প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যা পরবর্তীতে নেকমরদ মেলা নামে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ আমলেও এ মেলা অব্যাহত ছিল, এবং ১৮৬০ সালের মেজর শেরউইলের ভূমি নকশায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১ বৈশাখে শুরু হয়ে, মাসব্যাপী এ মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে লোক সমাগম ঘটত।
খানকাহ ও আওরঙ্গজেবের দান:
সুফি নেকমরদের খানকাহ জ্ঞানচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) খানকাহটির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৭০০ বিঘা জমি দান করেন। নওয়াবী আমলে এটি ইসলাম প্রচার, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল।
উপসংহার:
নেকমরদ একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জনপদ। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী এর গুরুত্বকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ঐতিহাসিক ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করা প্রয়োজন।