জাতীয় স্বার্থ: একটি ব্যাখ্যা
জাতীয় স্বার্থ, ফরাসি শব্দ ‘raison d'être’ থেকে উদ্ভূত, একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বস্তুতন্ত্রবাদে, একটি রাষ্ট্রের আচরণ তার জাতীয় স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত বলে বিশ্লেষণ করা হয়।
জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন স্তর রয়েছে: রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং সাংস্কৃতিক রক্ষণাবেক্ষণ। প্রাচীনকালে ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয় জাতীয় স্বার্থের চেয়ে অগ্রাধিকার পেত। কিন্তু ইতালীয় দার্শনিক নিকোলো মাকিয়াভেল্লি প্রথম জাতীয় স্বার্থকে রাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
ফরাসি প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল রিশোলিও তিরিশ বছর যুদ্ধের সময় (১৬১৮-১৬৪৮) জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে কৌশলী নীতি গ্রহণ করেন। ক্যাথলিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে জোট বেঁধে রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব কমাতে চেষ্টা করেন। জন দ্য সিলন এই নীতিকে ‘বিবেকের তাগিদ বনাম বাস্তবে করণীয়’ সমঝোতা বলে ব্যাখ্যা করেন। এরপর থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থ গুরুত্ব পেতে থাকে।
বস্তুতন্ত্রবাদের মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতি। ১৮১৪ সালের ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো শক্তি ও প্রভাবের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধারণা সমালোচিত হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে নীতি নির্ধারকগণ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যার ফলে লীগ অফ নেশান্সের জন্ম হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের অভাব এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থের সাথে সংঘাতের কারণে লীগ অফ নেশান্স ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বস্তুতন্ত্রবাদ পুনরুজ্জীবিত হয়। লীগ অফ নেশান্সের ব্যর্থতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে দেখা হয়। বস্তুতন্ত্রবাদীরা মনে করেন, লীগ অফ নেশান্সের আদর্শবাদী নীতি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি এবং যুদ্ধ রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় স্বার্থ বস্তুতন্ত্রবাদের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। বস্তুতন্ত্রবাদীরা মনে করেন, আদর্শবাদী বৈদেশিক নীতি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর নির্ভরশীল করে তোলে এবং এর ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই জাতীয় স্বার্থের রক্ষাই রাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।