চা: এক অমৃত পানীয়ের কাহিনী
চা, পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়। এর সুগন্ধ, স্বাদ ও প্রশান্তিদায়ক প্রকৃতি মানুষকে বারবার আকর্ষণ করে। কিন্তু এই চা কী, কোথা থেকে এল, এর ইতিহাস কেমন? আসুন জেনে নেই চা-এর বিস্তারিত ইতিহাস, উৎপাদন প্রক্রিয়া, এবং বাংলাদেশের চা শিল্পের বর্তমান অবস্থা।
চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinensis। চীন এর আদি জন্মভূমি বলে মনে করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, চীনে ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চা প্রথম চাষ করা হয়। ধারণা করা হয়, চীনা গ্রিক দেবী থিয়ার নামানুসারে এর নামকরণ করেছিল ‘টি’। চীনে ‘টি’-এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’, যা পরে ‘চা’ রূপে পরিচিত হয়। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চীনে চা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। ভারতে চা চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, আর বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশরা সিলেটে ১৮৫৫ সালে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়।
চা প্রধানত ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের পাহাড়ি ও উচ্চভূমিতে চাষ হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু চা উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চা গাছ রোপণ থেকে পাতা সংগ্রহ, শুকানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকিং- সবকিছুতেই শ্রমিকের প্রয়োজন। মহিলা শ্রমিকরা পাতা সংগ্রহে বিশেষ দক্ষতা রাখেন।
চা-এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে - কালো চা, সবুজ চা, উলং চা, ইষ্টক চা, প্যারাগুয়ে চা, সাদা চা, হলুদ চা, পুয়ের চা ইত্যাদি। এদের মধ্যে কালো চা সবচেয়ে প্রচলিত। চা মিশ্রণ একটি কঠিন কাজ, যা অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়। লিপ্টন, ব্রুকবণ্ড প্রভৃতি চা প্রস্তুতকারক কোম্পানী এই ক্ষেত্রে বিখ্যাত। দার্জিলিংয়ের চা বিশ্বখ্যাত তার অসাধারণ সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য।
২০০৮ সালে বিশ্বে প্রায় ৩৮,০০,০০০ টন চা পাতা উৎপাদিত হয়েছিল। চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা চা উৎপাদনে অগ্রণী। বাংলাদেশে চা উৎপাদন প্রধানত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে হয়। সিলেট বিভাগে ১৪৮টি চা বাগান থাকলেও, সম্প্রতি পঞ্চগড়ে অনেক চা বাগান স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড চা শিল্পের নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশের চা উৎপাদন প্রায় ৬০০ মিলিয়ন কেজি। এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের চা বিশ্বব্যাপী ‘সিলেট টি’ নামে খ্যাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অরগ্যানিক চা উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য চুক্তি হয়েছে।
চা শুধুমাত্র একটি পানীয় নয়; এটি একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, কৃষি, এবং অর্থনীতির আধার। চা উৎপাদন এবং রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।