চট্টগ্রামের রাউজান: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়
রাউজান, চট্টগ্রাম জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং উন্নয়নের এক অসাধারণ সমন্বয়ের জন্য পরিচিত। ২৪৬.৫৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলা ২২°২৫´ থেকে ২২°৪০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৫১´ থেকে ৯১°৫৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। উত্তরে ফটিকছড়ি ও কাউখালী, দক্ষিণে বোয়ালখালী উপজেলা ও কর্ণফুলি নদী, পূর্বে রাঙ্গুনিয়া এবং কাউখালী উপজেলা (রাঙ্গামাটি), এবং পশ্চিমে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত রাউজানের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই জুড়ে রয়েছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
রাউজানের ইতিহাস বৌদ্ধ সভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ৪০০ বছরের পুরোনো বৌদ্ধ বিহার এই কথা প্রমাণ করে। মোগল আমলে চট্টগ্রাম বিজয়ের আগে থেকেই এ অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ বা আরাকানীদের অধীনে ছিল। রাউজান নামের উৎপত্তি এই ঐতিহ্যের সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়। আরাকানী ভাষায় রজোওয়াং বা রাজ পরিবারের ভূমি বলে একে অভিহিত করা হতো, যা পরবর্তীতে রাউজানে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাউজান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকবাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল এই উপজেলা। পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তরপাড়া গ্রাম, চুয়েটের সামনে এবং জগৎমল্লাপাড়ায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
কর্ণফুলি ও হালদা- দুটি প্রধান নদী রাউজানের ভূমিকে সমৃদ্ধ করেছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ৩২২,৮৪০, যার মধ্যে পুরুষ ১৫৬,২৫৫ এবং মহিলা ১৬৬,৫৮৫। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে। মারমা, ত্রিপুরা, মগ প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীও রয়েছে।
অর্থনৈতিক কার্যকলাপ:
রাউজানের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। ধান, গম, আলু, মরিচ, চীনাবাদাম, শাকসবজি, সরিষা প্রধান কৃষি ফসল। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রধান ফল। রাউজান রাবারের চাষের জন্যও বিখ্যাত। ঔষধ তৈরির কারখানা, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাবার উৎপাদন কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। কুটির শিল্প, যেমন স্বর্ণশিল্প, মৃৎশিল্প, বুনন শিল্প এখানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ২৬ টি হাটবাজার এবং ৮ টি মেলা রাউজানের বাণিজ্যিক কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
শিক্ষার হার ৬২.৩%। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতি এখানে সমৃদ্ধ। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, মেলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রাউজানের ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখে।
দর্শনীয় স্থান:
মাস্টারদা সূর্যসেনের বাস্তুভিটা ও স্মৃতিসৌধ, মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির, জগৎপুর আশ্রম, নবীনচন্দ্র সেনের বাস্তুভিটা ও স্মৃতিসৌধ রাউজানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।
উপসংহার:
রাউজান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উন্নয়নের এক অসাধারণ সমন্বয়। এই উপজেলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ এবং বিকাশে আমাদের সকলের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা জরুরী।