কাপাসিয়া: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়
বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়া উপজেলা একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। সংস্কৃত ও হিব্রু ভাষায় তুলার অপর নাম কার্পাস, যা হিন্দিতেও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে এ অঞ্চলে তুলা উৎপাদনের প্রাচুর্যের কারণেই এর নামকরণ করা হয় কাপাসিয়া। ২৪.১০° উত্তর অক্ষাংশ ও ৯০.৫৭° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই উপজেলা উত্তরে ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, দক্ষিণে কালীগঞ্জ ও নরসিংদীর পলাশ, পূর্বে নরসিংদীর মনোহরদী ও শিবপুর এবং পশ্চিমে শ্রীপুর উপজেলার সীমানা দিয়ে ঘেরা।
- *ঐতিহাসিক গুরুত্ব:** কাপাসিয়া একটি প্রাচীন জনপদ, যার ভূমি গঠিত হয়েছে ২৫ লক্ষ বছর আগে। উল্লেখযোগ্য প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে একডালা দুর্গ অন্যতম, যা উপজেলা সদর থেকে ৫ কিমি দূরে কালী বানার, শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে কোনো হিন্দু রাজা দুর্গটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। পান্ডুয়ার শাসক হাজী শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তীকালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র নাসির উদ্দিন শাহ (১৫১৮-১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ) দুর্গটি সংস্কার করেন। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে রাজা টোডরমল এ অঞ্চলকে ভাওয়াল পরগণায় অন্তর্ভুক্ত করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে কাপাসিয়া থানায় ২৮টি ইউনিয়ন ছিল, যা ১৯২৪ সালে কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর থানায় বিভক্ত করা হয়। ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কাপাসিয়া থানা ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর উপজেলায় উন্নীত হয়। মুক্তিযুদ্ধে কাপাসিয়া বাজারে পাকবাহিনীর অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ের ইতিহাস কাপাসিয়াকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
- *ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:** কাপাসিয়ার আয়তন ৩৫৬.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৩,২১,৪৫৪ (পুরুষ ১,৬২,৩০৩, মহিলা ১,৫৯,১৫১)। শিক্ষার হার ৫৬.৪১%।
- *অর্থনীতি:** কাপাসিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। ধান, পাট, গম, আলু, আখ, সরিষা প্রধান কৃষি ফসল। মৎস্য, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামারও উল্লেখযোগ্য। কুটিরশিল্প যেমন স্বর্ণশিল্প, লৌহশিল্প, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্প, তাঁতশিল্প, বিড়িশিল্প, নকশি কাঁথা ইত্যাদি এখানে বেশ জনপ্রিয়। প্রগতি ব্যাংক, বাংলাদেশের প্রথম ভূমি উন্নয়ন ব্যাংক, কাপাসিয়াতেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
- *যোগাযোগ ব্যবস্থা:** সড়ক, নৌপথ ও রেলপথের মাধ্যমে ঢাকা থেকে কাপাসিয়ায় যাতায়াত করা যায়।
- *দর্শনীয় স্থান:** একডালা দুর্গ, দরদরিয়া দুর্গ, শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্র নদীর মিলনস্থল, তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ি (দরদরিয়া), কামড়া ইকো পার্ক, ফকির মজনু শাহ সেতু প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান কাপাসিয়ার আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছে।
কাপাসিয়া ঐতিহ্যের ধারক, সংস্কৃতির আধার এবং উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান একটি উপজেলা। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সকলের কাছে একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।