উত্তর ভারত

উত্তর ভারত: ভারতের একটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অঞ্চল

উত্তর ভারত ভারতের উত্তরাংশের বিশাল এক ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চল, যেখানে ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু। এটি হিমালয় পর্বতমালা থেকে সিন্ধু-গঙ্গা সমভূমি, থর মরুভূমি, এবং দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তর-পশ্চিম অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতের আয়তন ও জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এ অঞ্চলে অবস্থিত, এবং মুম্বাই, দিল্লি ও কলকাতা – ভারতের তিনটি মেগাসিটি – উত্তর ভারতেই অবস্থিত। সংকীর্ণ অর্থে, গঙ্গা-যমুনা দোয়াব থেকে থর মরুভূমি পর্যন্ত এলাকা উত্তর ভারত হিসেবে ধরা হয়।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য:

উত্তর ভারতের মধ্য দিয়ে বহমান নদীগুলির মধ্যে সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা এবং নর্মদা উল্লেখযোগ্য। এখানকার প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হলো হিমালয়, সিন্ধু-গঙ্গা সমভূমি, এবং থর মরুভূমি। উত্তর ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে: উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, এবং পশ্চিমবঙ্গ। এছাড়াও, চণ্ডীগড়, দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর, এবং লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল উত্তর ভারতের অন্তর্গত।

জনসংখ্যা ও ধর্ম:

উত্তর ভারতের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ইন্দো-আর্য। হিন্দুধর্ম এখানকার প্রধান ধর্ম। ইসলাম, শিখধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মও অনুসরণ করা হয়। উত্তর ভারতের ৮০% এর বেশি হিন্দু, দিল্লির প্রায় ৯০% হিন্দু। গুজরাট, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ প্রধানত হিন্দু-সংখ্যাগুরু। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, এবং মহারাষ্ট্র-এ হিন্দুদের পাশাপাশি বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীও রয়েছে। ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। জম্মু ও কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগুরু, লাদাখে মুসলিমদের সাথে বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীও আছে। পাঞ্জাবে শিখ জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু।

ঐতিহাসিক ঘটনা:

উত্তর ভারত প্রাচীন ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। সিন্ধু সভ্যতা, বৈদিক সভ্যতা, মহাজনপদ, মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, দিল্লি সালতানাত, মুঘল সাম্রাজ্য – সবগুলোরই কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তর ভারত। ব্রিটিশ শাসনামলের পর স্বাধীন ভারতের গঠনেও উত্তর ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অর্থনীতি:

উত্তর ভারতের অর্থনীতি কৃষি ও শিল্প – উভয়ের উপর নির্ভরশীল। উত্তরের সমভূমি কৃষিকাজের উপর অনেকটা নির্ভরশীল, আর মহারাষ্ট্র, জাতীয় রাজধানী অঞ্চল (এনসিআর), এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে আগে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লবের কারণে উন্নয়ন হয়েছে। তবে, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ পিছিয়ে আছে, যার ফলে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠেছে।

সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:

উত্তর ভারতের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। অনেক হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ তীর্থস্থান এখানে অবস্থিত, যেমন – হরিদ্বার, বারাণসী, অযোধ্যা, মথুরা, প্রয়াগরাজ, আমৃতসর (সোনার মন্দির), সারনাথ ইত্যাদি। মুঘল স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত – তাজমহল, লালকেল্লা, আগ্রা দুর্গ, কুতুব মিনার ইত্যাদি –ও উত্তর ভারতে অবস্থিত। হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে উত্তর ভারতের এক অনন্য ‘গঙ্গা-যমুনা তহজিব’ গড়ে উঠেছে।

মূল তথ্যাবলী:

  • উত্তর ভারত হল ভারতের উত্তরাংশের একটি বিশাল ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চল।
  • এখানে ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু এবং হিন্দুধর্ম প্রধান ধর্ম।
  • হিমালয়, সিন্ধু-গঙ্গা সমভূমি, থর মরুভূমি এ অঞ্চলের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য।
  • মৌর্য, গুপ্ত, মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তর ভারত।
  • তাজমহল, লালকেল্লা, সোনার মন্দির, বারাণসী ইত্যাদি উত্তর ভারতের বিখ্যাত স্থান।