আব্দুল জলিল: বাংলাদেশের রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নেতা
মোহাম্মদ আব্দুল জলিল (২১ জানুয়ারি ১৯৩৯ - ৬ মার্চ ২০১৩) ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন অসাধারণ সংগ্রামী। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন বাণিজ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে দীর্ঘদিন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নওগাঁ-৫ আসন থেকে বিজয়ী হন। ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি কয়েক বছর বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
আব্দুল জলিলের জন্ম নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার চকপ্রাণ গ্রামে। তার বাবা ফয়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি নওগাঁ কে. ডি. সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য লন্ডনে যান, কিন্তু ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় দেশে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধে আব্দুল জলিলের অবদান অসামান্য। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের ডাকের পর তিনি নওগাঁ ও উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একীভূত করেন। নওগাঁ থেকে ৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারতে গিয়ে বালুরঘাটে ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা তার তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে উত্তরাঞ্চলের জেনারেল হিসেবে অভিহিত করেন। নওগাঁ শহরের উত্তর-পশ্চিমে আব্দুল জলিল চত্বরে ৭১ ফুট উঁচু বিজয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ তার স্মৃতি রক্ষা করে।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে নওগাঁর গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার হন। মুক্তির পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এবং ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তিনি দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যা ও হৃদরোগে ভোগেন এবং ২০১৩ সালের ৬ মার্চ সিঙ্গাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। নওগাঁয় তার নিজ বাসভবনে তাকে দাফন করা হয়। আব্দুল জলিলের জীবন ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে একজন অসাধারণ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।