আবদুল হাই নামটি একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এই নিবন্ধে উল্লেখিত বিভিন্ন আবদুল হাই-এর জীবনী, কর্মজীবন এবং অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে:
১. বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই:
এই আবদুল হাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার জন্ম ঢাকায়। বাবা মাহমুদুর রহমান এবং মা মাঘবুলেন নেছা। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। কামালপুর (জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলা)সহ আরও কয়েকটি স্থানে তিনি সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। ২৮ জুলাই ১৯৭১-এর রাতে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের সাথে কামালপুরের একটি পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিতে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে গিয়ে তিনি দুই পাকিস্তানি সেনার সাথে লড়াই করেন এবং তাদের হত্যা করেন, ফলে ক্যাপ্টেন মমতাজের প্রাণ রক্ষা হয়। তার বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।
২. কথাসাহিত্যিক মিরজা আবদুল হাই:
মিরজা আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৮৪) ছিলেন একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম মিরজা আবু মুসা আবদুল হাই। তিনি ১৯১৯ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার আবদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ হন। তিনি আসাম প্রাদেশিক সরবরাহ বিভাগে কর্মরত ছিলেন এবং পরে ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। তিনি বহু গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে 'ছায়া-প্রচ্ছায়া', 'বিস্ফোরণ', 'ফিরে চলো', 'তোমার পতাকা' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 'ফিরে চলো' মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক উপন্যাস। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।
৩. শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই:
মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি ১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর মুর্শিদাবাদের রাণীনগর থানার মরিচা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম মুসলমান ছাত্র যিনি বিএ অনার্স ও এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৫০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর 'ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব' গ্রন্থটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৯৬ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকায় মারা যান।
৪. আলেম, পীর ও সমাজকর্মী আবদুল হাই সিদ্দিকী:
আবদুল হাই সিদ্দিকী (১৯০৩-১৯৭৭) ছিলেন একজন প্রভাবশালী আলেম, পীর এবং সমাজকর্মী। তার প্রকৃত নাম আবু নসর মুহাম্মদ আবদুল হাই। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ফুরফুরায় তার জন্ম। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন এবং বিভিন্ন মাওলানার কাছে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ফুরফুরার পীর ছিলেন এবং 'বড় হুজুর' নামে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতিতে তার প্রভাব ছিল। তিনি আঞ্জুমানে ওয়ায়েজিন, জমিয়তে উলামায়ে বাংলা ও আসাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
৫. কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার:
আবদুল হাই শিকদার (জন্ম: ১৯৫৭) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। তিনি কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'কথামালা' নামক একটি জনপ্রিয় শিকড় সন্ধানী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। তিনি ১২০ টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।